একদিনে শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা চার হাজার ছাড়াল

পুলক ঘটক ও জেসমিন পাপড়ি
2020.06.17
ঢাকা
200617_Daily_virus_1000.JPG করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম পরে কাজ করছেন ঢাকার মতিঝিল এলাকার একটি ব্যাংকের কর্মীরা। ২৫ মার্চ ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একদিনে শনাক্ত করোনাভাইরাস আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা চার হাজার ছাড়াল।

বুধবার নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এই নিয়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ৪৮৯ জনে।

এ দিন আরো ৪৩ জন মারা যাওয়ায় করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছেছে এক হাজার ৩০৫ জনে।

করোনায় বুধবার আরো তিনজন চিকিৎসক মারা গেছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।

সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত করোনায় ৪১ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসক, নার্সসহ এ পর্যন্ত তিন হাজার ২৭৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৮২ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন চার লাখ ৪৫ হাজারের বেশি।

করানোয় চাকুরিচ্যুতি, বেতন কমছে

করোনাভাইরাসের কারণে জীবিকায় আঘাত পড়েছে ব্যাংক-বীমা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিষ্ঠানে জড়িত মানুষদের ওপর। ব্যাংক কর্মচারীদের বেতন কমেছে ১৫ শতাংশ এবং চাকরি হারাচ্ছেন অনেক গণমাধ্যমকর্মী।

“শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের ছাঁটাই করছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান ওয়েজবোর্ডের আওতায় নিযুক্ত সাংবাদিকদের চুক্তিভিত্তিক কাজ করতে বাধ্য করছে,” বেনারকে বলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ।

টিকে থাকার প্রয়োজনে চাকুরিচ্যুত না করে দেশের ৪১টি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কর্মচারীর বেতন ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে সকল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও নির্বাহীদের কাছে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশে অ্যাসোশিয়েন অব ব্যাংকস (বিএবি)।

“চাকুরিচ্যুত না করে বেতন কমানোটাই আমরা ভালো মনে করেছি। এটা না করলে ব্যাংকগুলো এখন টিকতে পারবে না,” বেনারকে জানান বিএবি’র সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার।

এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বেনারকে বলেন, “করোনার কারণে অর্থনীতির উপর আঘাত এসেছে এবং শ্রমজীবি মানুষ সংকটে পড়েছে। এজন্য সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়িয়ে দিয়েছে এবং বিশেষ প্রণোদনার আওতায় সংকটগ্রস্ত প্রায় সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।”

আবার দারিদ্রে প্রত্যাবর্তন?

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা অসংখ্য শ্রমিকও করোনাভাইরাসের কারণে কর্ম হারিয়েছেন।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসাব অনুযায়ী, গত ২৬ মার্চ থেকে ৬৬ দিনে দেশের প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসের কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন।

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সাধারণ অথনীতি বিভাগ) সামসুল আলম বেনারকে বলেন, “করোনা ভাইরাসের কারণে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে যাবে। আমরা আশঙ্কা করছি ৪০ লাখেরও অধিক মানুষ হতদরিদ্রে পরিণত হবে। আগামী দিনগুলোতে তাঁদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেটাই এখন আমাদের ভাবনা।”

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ৭ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, ইতোমধ্যে দারিদ্রের হার ১০ শতাংশ বেড়েছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৫ বছরের আগের অবস্থায় অর্থাৎ ৪০ শতাংশে পৌঁছাবে।

সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বেকার মানুষের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে এবং মানুষের আয় মারাত্মকভাবে কমে গেছে। বেসরকারি খাতের অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেননি।

“দারিদ্রের হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বর্তমান দারিদ্র হার ২০.৫ শতাংশ থেকে আবার আগের অবস্থায় অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছি,” বলেন তিনি।

পোশাক কর্মীদের বিক্ষোভ

করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই পোশাক শিল্পে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ আসছিল। এরপর গত ৪ জুন পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে পোশাক কারখানার কাজ কমে আসায় জুন থেকেই শ্রমিকদের ছাঁটাই শুরু হবে।

চাকুরিচ্যুতির প্রতিবাদে করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে কয়েকদিন ধরেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সাভার এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় বিক্ষোভ করেছে পোশাক শ্রমিকরা।

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র সভাপতি মন্টু ঘোষ বেনারকে বলেছেন, “করোনাভাইরাসের অজুহাতে গার্মেন্টস মালিকরা নির্দয়ভাবে শ্রমিক ছাঁটাই করছে। সরকারি প্রণোদনা তাহলে কোথায় গেলো?”

শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বেনারকে বলেন, “গার্মেন্টসখাতে এখন পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। যারা ট্রেড ইউনিয়নের সাথে জড়িত তাঁদের আগে বাদ দেয়া হচ্ছে।”

মিডিয়ার দুঃসময়

করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারিয়েছেন অনেক গণমাধ্যমকর্মী, অনেকের আয় কমে গেছে মারাত্মকভাবে।

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে সংসদে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত সংবাদপত্রের সংখ্যা ৩ হাজার ২৫টি। যার মধ্যে এক হাজার ১৯১টি দৈনিক সংবাদপত্র। শুধু ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ৪৭০টি পত্রিকা।

করোনা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই অনিয়মিত এবং স্বল্প প্রচার সংখ্যার সংবাদপত্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

এসব প্রতিষ্ঠানে সারাদেশে মোট কত সাংবাদিক কাজ করেন তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জরিপ নেই। তবে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট গত ৩ মে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে বাংলাদেশের দুই সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা এবং ইউনিয়ন বহির্ভূত সাংবাদিক মিলিয়ে সারাদেশে প্রায় ২০ হাজার সাংবাদিক সার্বক্ষণিক অথবা খণ্ডকালীন হিসেবে কর্মরত আছেন।

“সাংবাদিক ছাড়াও মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত সাধারণ শ্রমিক, কর্মচারী এবং হকার মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষ কর্ম হারিয়েছেন অথবা তাঁদের আয় মারাত্মকভাবে কমে গেছে,” বেনারকে বলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ।

তিন মাস পরে চালু আন্তর্জাতিক ফ্লাইট

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তিন মাস বন্ধ থাকার পর মঙ্গলবার বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক রুটে নিয়মিত যাত্রীবাহী ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়েছে।

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক এএইচএম তৌহিদ উল আহসান বেনারকে জানান, মঙ্গলবার রাত থেকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট ৩৩ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকা পৌঁছায় এবং রাত ৩টা ১০ মিনিটে ২৭৪ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে দোহার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আরেকটি ফ্লাইট।

তিনি জানান, আপাতত কাতার এয়ারওয়েজ সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করবে। এছাড়া ২১ শে জুন থেকে লন্ডন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত ১৬ মার্চ থেকে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের অন্য সব দেশের সঙ্গে নিয়মিত ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ। পরে চীনের সঙ্গে সীমিত পরিসরে ছাড়া অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়।

কয়েকবার নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর পর গত ১ জুন আভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীবাহী বিমান চলাচল শুরু হয়। আর আন্তর্জাতিক রুটে নিষেধাজ্ঞা থাকে ১৫ জুন পর্যন্ত।

অন-অ্যারাইভাল ভিসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করলেও সকল দেশের নাগরিকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। তবে শুধুমাত্র বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের বিদ্যমান ভিসা নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশে আগমনী ভিসা দেওয়া যাবে।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ভিসা প্রার্থীকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সাথে ‘কোভিড-১৯ মুক্ত’ সনদ দেখাতে হবে।

গত ১৫ মার্চ থেকে কয়েক দফায় ১৫ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ‘ভিসা অন-অ্যারাইভাল’ সুবিধা স্থগিত করা হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।