বাংলাদেশে চীনা করোনাভাইরাস টিকা পরীক্ষার নীতিগত অনুমোদন
2020.07.20
ঢাকা
বাংলাদেশে চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের উৎপাদিত করোনাভাইরাস টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার নীতিগত অনুমতি সংক্রান্ত কাগজপত্র বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) কাছে চেয়ে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবার বেনারকে বলেন, এই অনুমতি দেয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করেনি বিএমআরসি। এমনকি মন্ত্রণালয়কে অবহিতও করা হয়নি।
রোববার সিনোভ্যাকের পক্ষে আবেদন করা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইসিডিডিআরবি) দেশের সাতটি সরকারি হাসপাতালে দুই হাজার ১০০ স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর এই টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার নীতিগত অনুমোদন দেয় বিএমআরসি।
এটিই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কোনো টিকার প্রথম পরীক্ষা।
এই টিকার প্রথম এবং দ্বিতীয় ট্রায়াল চীনে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বিএমআরসি’র রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালক মাহমুদ উজ জাহান বেনারকে বলেন, ট্রায়ালটি কার্যকর করতে এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি লাগবে আইসিডিডিআর,বি’র।
“বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল মন্ত্রণালয়কে অবহিত না করেই সিনোভ্যাকের টিকার এথিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে,” মন্তব্য করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বেনারকে বলেন, তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর বিএমআরসি’র কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে পাঠিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমি নিজে চীনাদের কাছে ভ্যাকসিন চেয়েছিলাম। সিনোভ্যাক টিকা তৈরি করেছে এটি ভালো কথা। কিন্তু এব্যাপারে আমাদের বিস্তারিত জানতে হবে। আমরা তাদের কাগজপত্রগুলো দেখে সিদ্ধান্ত নেব।”
“কারণ টিকা একটি সংবেদনশীল বিষয়,” বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল বাস্তবায়নের জন্য সিনোভ্যাকের পক্ষে আইসিডিডিআরবি মাস খানেক আগে বিএমআরসি’র কাছে আবেদন করে বলে জানান মাহমুদ উজ জাহান।
তিনি বলেন, “প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও পূর্বের গবেষণা ফলাফল পরীক্ষা করে আমাদের এথিক্যাল কমিটি বাংলাদেশে সিনোভ্যাকের টিকার ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে।”
“আমরা দেখেছি সব কাগজপত্র ঠিক আছে,” জানিয়ে মাহমুদ উজ জাহান বলেন, “এখন মানুষের ওপর ট্রায়ালের জন্য তাদের ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন হবে।”
“যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে আগামী একমাসের মধ্যে এই ট্রায়াল শুরু হবে,” বলেন মাহমুদ উজ জাহান।
এদিকে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন আইসিডিডিআর,বি’র জনসংযোগ কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম খান।
“আমাদের নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (তথ্য প্রচার না করার চুক্তি) আছে,” জানিয়ে তিনি বলেন “চুক্তি হলে আপনারা জানতে পারবেন।”
‘রোগীদের খারাপ কিছু হবে না’
চীনা যে টিকার ট্রায়াল বাংলাদেশে হতে যাচ্ছে সেটির আগের দুটো ট্রায়াল চীনে হয়েছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী।
তিনি বলেন, “এখন যে ট্রায়াল হবে সেখানে রোগীদের কোনো খারাপ কিছু হবে না।”
“এই ট্রায়ালে মূলত দেখা হবে কোন বয়সে কী পরিমাণে ওষুধ লাগবে, কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, যেমন মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, অথবা অন্য কোনো সমস্যা দেখা যাচ্ছে কি না,” বলেন ডা. এহতেশামুল।
তিনি বলেন, “এই ট্রায়ালে টিকাটির ব্যবহার সুনির্দিষ্ট করা হবে। মেডিক্যালি প্রটোকল ঠিক করা হবে।”
যেভাবে টিকার পরীক্ষা হয়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের ১৬০টির বেশি টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে, এবং মানব শরীরে পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে ২৬টি। এর মধ্যে সিনোভ্যাকসহ তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চলছে চারটি ভ্যাকসিনের।
ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের পর মানবদেহে পরীক্ষার আগে প্রথমে ইঁদুর বা বানরের ওপর পরীক্ষা করে প্রাথমিক কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় বলে জানায় দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের করোনাভাইরাস ট্র্যাকিং সেন্টার।
প্রথম ধাপের পরীক্ষার সফলতার উপর ভিত্তি করে শুরু হয় মানবদেহে পরীক্ষা।
মানবদেহে পরীক্ষার প্রথম ধাপে ভ্যাকসিনটির প্রয়োজনীয় পরিমাণ ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো পরীক্ষার জন্য অল্প কিছু মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়।
প্রধম ধাপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় ধাপে ভ্যাকসিনটি পরীক্ষা করা হয় বিভিন্ন বয়সের শতাধিক মানুষের ওপর। এই পর্যায়ে মূলত বয়সভেদে বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়।
তৃতীয় ধাপে কয়েক হাজার মানুষের ওপর ভ্যাকসিনটির পরীক্ষা চলানো হয়।
এই পর্যায়ে ভ্যাকসিন পরীক্ষায় আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবীদের দুইভাগে ভাগ করে এক দলকে দেয়া হয় মূল ভ্যাকসিন, আর আরেকদলকে দেয়া হয় ভ্যাকসিনের আদলে তৈরি প্ল্যাসিবো বা সান্ত্বনাসূচক ভ্যাকসিন।
তবে গবেষকরা ছাড়া অংশগ্রহণকারীদের কেউ জানেন না কে কোন ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন।
এই পর্যায়ে দেখা হয় ভ্যাকসিন নেওয়া অংশগ্রহণকারী ও ভ্যাকসিন না নেওয়া অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের তুলনামূলক চিত্র।
মানবদেহে ভ্যাকসিন পরীক্ষার তৃতীয় ধাপটিই চূড়ান্ত ধাপ। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশ তা ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত সীমিতা আকারে ব্যবহারের অনুমতি মিলেছে শুধু করোনাভাইরাস একটি ভ্যাকসিনের।
দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের করোনাভাইরাস ট্র্যাকিং সেন্টারের তথ্যমতে, চীনা কোম্পানি ক্যানসিনো বায়োলজিকস ও চীনের মিলিটারি মেডিকেল সাইন্স একাডেমির যৌথ উদ্যোগে উদ্ভাবিত একটি ভ্যাকসিনকে গত ২৫ জুন সীমিত আকারে সৈনিকদের মধ্যে ব্যবহার করতে এক বছরের জন্য অনুমতি দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী।
সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্যমতে চলতি বছরের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৮-৬০ বছর বয়েসি ৪২২ জনের ওপর চীনে সিনোভ্যাকের টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়।
তৃতীয় ধাপে ১৮ বছরের বেশি বয়স্ক মোট আট হাজার ৮৭০ জন মানুষের ওপর টিকাটির কার্যকারীতা পরীক্ষা করা হবে। এই পর্যায়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন শুধু বিভিন্ন হাসপাতালের করোনা ইউনিটে কর্মরত স্বাস্থ্যকমীরা।
তবে যারা আগে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, বা যারা গর্ভবতী, অথবা যাদের দুধের বাচ্চা রয়েছে তাঁরা এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
সিনোভ্যাকের টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা ইতিমধ্যেই ব্রাজিলে শুরু হয়েছে।
এক বছরের বেশি মেয়াদের এই তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ শেষ হবে। ফলাফল পেতে ওই বছরের অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে জানায় ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন।
বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হবে জানিয়ে মাহমুদ উজ জাহান বলেন, “প্রায় দুই হাজার ১০০ জনের ওপর এই ট্রায়াল পরিচালনা করা হবে। এই ট্রায়াল সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন হবে।”
করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়, ঢাকার এমন সাতটি সরকারি হাসপাতাল ইতিমধ্যে আইসিডিডিআর,বির কাছে এই ট্রায়ালের জন্য আবেদন করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি ট্রায়ালে এর কার্যকারিতার প্রমাণ মেলে তবেই সেটি বাজারজাত করা হবে।”
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে ৮ মার্চ। আর এই ভাইরাসে প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই লাখ সাত হাজার ৪৫৩ জন। আর মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ৬৬৮।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক কোটি ৪৫ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ছয় লাখ সাত হাজারের বেশি।