অক্টোবরের মাঝামাঝি খুলবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
2021.08.26
ঢাকা
দেশের ১৬০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে খুলতে শুরু করবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রতিনিধিদের এক ভার্চুয়াল বৈঠকে বৃহস্পতিবার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
তবে সরকার বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বিভিন্ন ছাত্র-পেশাজীবী-সামাজিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের দাবি উপেক্ষা করে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটি আরেক দফা বাড়িয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
“মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে,” বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে সর্বশেষ ঘোষণায় ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি বাড়িয়েছিল তারা।
গত ১৮ অগাস্ট সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংক্রমণ ও টিকাদান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন জানিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জোর প্রস্তুতি চলছে।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে যে কোনো দিন স্কুল খুলে দিতে তাঁরা প্রস্তুত। একই দিনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও বলেছিলেন, শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবারের বৈঠকে ২ সেপ্টেম্বর পুনরায় যৌথসভা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ইউজিসি চেয়ারম্যান বেনারকে বলেন, “বৈঠকে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতিসহ স্বাস্থ্য বিভাগের দুই কর্মকর্তা আমাদের জানিয়েছেন বর্তমানে সংক্রমণের হার একটু কমছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এটা সাত-আট শতাংশে নেমে আসবে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার জন্য নমুনার বিপরীতে সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসাটা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী। কারণ মাত্র তিন-চার সপ্তাহ আগেও এই হার প্রায় ৩০ শতাংশ ছিল।
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৫ হাজার ৭২৯ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও চার হাজার ৬৯৮ জনসহ দেশে মোট ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৬২৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে উল্লেখ করে এতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এদিকে “শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করা একদমই উচিত হবে না,” উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক বেনারকে বলেন, “আমরা দেখেছি, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে কিন্তু প্রচুর তরুণ, এমনকি শিশুরাও আক্রান্ত হয়েছে। আরো নতুন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ ছড়াবে, এমন শঙ্কাও কিন্তু রয়েছে।”
“শিক্ষার চেয়ে বেঁচে থাকাটা জরুরি,” বলেন তিনি।
তবে “করোনাকে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। যেকারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ আমরা রুদ্ধ রাখতে পারি না,” মন্তব্য করে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, “তবুও সংক্রমণের হার আবার বেড়ে গেলে সিদ্ধান্ত বদলাতে হতে পারে।”
শর্তসাপেক্ষে খুলবে বিশ্ববিদ্যালয়
“বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শতভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ টিকাদানের উপযোগী কর্মরত সবাইকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে করোনার টিকাদান সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে,” বলে জানান ড. শহীদুল্লাহ।
টিকাদানের মাত্রা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছালেই ১৫ অক্টোবর থেকে ক্যাম্পাস খুলতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে থেকে টিকাদান সংক্রান্ত তথ্য ছক আকারে ইউজিসিতে পাঠাতে হবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা এক নয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রও আলাদা। যে কারণে সবার জন্য এক নীতি খাটবে না। যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন নিরাপদ মনে করবে তখন ক্যাম্পাস খোলার সিদ্ধান্ত নেবে।”
কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি ১৫ অক্টোবরের আগে প্রস্তুত না হয় তার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বসিয়ে রাখার পক্ষে নয় ইউজিসি।
উদাহরণ হিসেবে ড. শহীদুল্লাহ বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য এখনই প্রায় প্রস্তুত। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে এমন কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৯৫ শতাংশের বেশি টিকার আওতায় এসেছেন দাবি করে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, “দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাদের সবাইকে টিকার আওতায় এনে ক্যাম্পাস খোলার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই নিতে হবে।”
‘একসাথে সব ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া ঠিক হবে না’
ইউজিসির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৫০টি পাবলিক, ১০৭টি বেসরকারি এবং তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় সরকারি ও বেসরকারি কলেজের সংখ্যা দুই হাজার ২৪৯টি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও একই নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে জানালেও ড. শহীদুল্লাহ মনে করেন, একসাথে সব শিক্ষার্থীর জন্য ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া ঠিক হবে না।
একই বক্তব্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. রুহুলের। বেনারকে তিনি বলেন, “সবকিছু একত্রে খুলে দিয়ে ক্যাম্পাস ও হলগুলোয় ভিড় বাড়ানো উচিত হবে না। যে কোনো একটা ক্যাম্পাস বা হল সংক্রমিত হলে পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সামলানো যাবে কিনা সেটাও ভাবতে হবে।”
“ভিড় ঠেকাতে সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পাশাপাশি বিগত দুই বছর ধরে চলমান অনলাইনে পাঠদান ও পরীক্ষা নেওয়াও অব্যাহত রাখতে হবে,” যোগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের এই সাবেক চেয়ারম্যান।
তবে মঙ্গলবারও এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, “একমাত্র যারা বিত্তশালী মানুষ, তারাই অনলাইনে পড়াশোনা করতে পারছে।”
ইতিমধ্যে সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ধাপে ধাপে বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা ও সশরীরে একাডেমিক কার্যক্রম চালু করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
মঙ্গলবার দুপুরে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই সংগঠনটি বলেছে, টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছনে পড়ে আছে। কাজেই টিকা শেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাবলে আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও মননের উপর যে চাপ তৈরি হবে তা সামাল দেবার কোনো সমাধান আমাদের হাতে যে নেই, সেটা মনে রাখা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিকাদান কেন্দ্র খুলে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার দাবি জানান তাঁরা।
দেশে গত বছর ৮ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ধরা পড়ার পর ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এগুলো একাধিকবার খোলার তারিখ ঘোষণা করলেও পরে তা বাতিল করে সরকার।