করোনাভাইরাস সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পোশাক শিল্প

জেসমিন পাপড়ি
2020.09.03
ঢাকা
200903_RMG_sector_1000.jpg ঢাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক পরে কাজ করছেন শ্রমিকরা। ৩ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে কয়েক মাস পর ইতিবাচক গতিতে ফিরেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প। জুলাই ও আগস্টে প্রতিমাসে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি পোশাক রপ্তানি হয়েছে বলে জানিয়েছে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, যা আগের মাসগুলোতে পড়ে গিয়েছিল একেবারে তলানির পর্যায়ে।

বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করলেও এখনো পোশাক শিল্পের সংকট পুরোপুরি কাটেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

“করোনার কারণে যেসব অর্ডার আটকে ছিল সেগুলোই ছাড় হচ্ছে, নতুন করে বড়ো কোনো অর্ডার আমরা পাইনি,” বেনারকে বলেন বিজিএমই’র ভাইস প্রেসিডেন্ট মশিউল আলম।

জুন-জুলাইয়ের তুলনায় পরের দুই মাসে রপ্তানি বাড়লেও “সার্বিকভাবে রপ্তানি বাড়েনি,” জানিয়ে তিনি বলেন “সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে কী হবে তা অনিশ্চিত।”

“মূল কথা হলে ইউরোপ–আমেরিকার বড় বড় স্টোরগুলো এখনও খোলেনি, অনলাইন প্লাটফর্মগুলো সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি। সুতরাং পণ্য বিক্রি না করতে পারলে অর্ডার আসবে কীভাবে,” বলেন মশিউল আলম।

এদিকে রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও “পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।

তিনি বলেন, “আপাতত ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়া পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে মাস্ক ও ব্যক্তগিত সুরক্ষাসামগ্রি (পিপিই) যাচ্ছে। এসব মিলিয়ে রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে।”

“কিছু কিছু নতুন ক্রয়াদেশ আসলেও ক্রেতারা এতটা কম মূল্য অফার করছে যে, সব ক্রয়াদেশ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না,” বলেন মোহাম্মদ হাতেম।

পোশাক রপ্তানি বাড়ার বিষয়টি ইতিবাচক হলেও শ্রম সচিব কেএম আবদুস সালামের মতেও, করোনা মহামারির কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা পুরোপুরি কেটে গেছে কি না “তা এখনই বলা মুশকিল।”

ইতিবাচক বলছেন অর্থনীতিবিদরা

বাংলাদেশে থেকে ক্রেতারা আবার পোশাক নিতে শুরু করার বিষয়টিকে “খুবই ইতিবাচক” মন্তব্য করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির এ ধারা বেশ আশাব্যঞ্জক।”

অর্থনীতিবিদ গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে, “তৈরি পোশাক খাত শুধু রপ্তানি আয়ই বাড়ায় না, এর সাথে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রা জড়িত।”

তিনি বলেন, “অর্ডার যদি বাড়ে বা স্থিতিশীলতা আসে তবে কারখানাগুলো সম্পূর্ণ লোকবল নিয়োগ করতে পারবে, যে কারখানা ৬৫ ভাগ মজুরি দিচ্ছে, তারা শতভাগ দিতে পারবে।”

এর ফলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার পাশাপাশি এ খাত সংশ্লিষ্ট সব সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

তবে পোশাক শিল্পে রপ্তানির চাকা ঘুরতে শুরু করলেও শ্রমিকদের বিশেষ সুবিধা হয়নি বলে জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।

“করোনা মহামারি শুরুর পর কারখানাভেদে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করা হয় জানিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা কে এম মিন্টু বেনারকে বলেন, “পোশাক কারখানা খোলার পর পুরানো কর্মীদের সাথে সাথে নতুন কর্মীরাও কাজের জন্য এসেছে।”

কারখানাগুলোতে কাজের আশায় প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক ভিড় করলেও প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্প শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে জানান মিন্টু।

তিনি বলেন, “প্রয়োজনের তুলনায় অল্পকিছু কর্মী নিয়োগ দিলেও মালিকেরা ইচ্ছেমতো শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে তাঁদের ওপর।”

এছাড়া “মার্চ–এপ্রিল পর্যন্ত কারখানাগুলোতে করোনা সংক্রমণ এড়াতে “কিছুটা স্বাস্থ্যবিধি মানা” হলেও এখন সেভাবে তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন এই শ্রমিক নেতা।

আগস্টে বছরের সর্বোচ্চ রপ্তানি

বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-জুন মাস পর্যন্ত পোশাক রপ্তানি ৩০০ কোটি ডলার ছাড়ায়নি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিস্থিতি ভালো হতে শুরু করলে জুলাইয়ে ৩২৪ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এরপর আগস্টে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৩৬ কোটি ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তুলনায় ৪৭ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলার পোশাক রপ্তানি হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এই আয় ছিল ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলার। ওই অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬১৮ কোটি ডলার কম রপ্তানি হয়েছে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে গত মার্চ থেকে তৈরি পোশাকে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ আসতে থাকে।

একই সময়ে দেশেও কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। এই ভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে প্রায় একমাসের মতো কারখানা বন্ধ থাকে। এতে করে এপ্রিল মাসে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। যা প্রায় ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন আয়।

এরপর মে মাসে ১২৩ কোটি ডলার ও জুনে তা বেড়ে ২২৫ কোটি ডলার রপ্তানি হয় বলে জানায় বিজিএমইএ।

পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়া শুরুর প্রেক্ষাপটে রপ্তানিমুখী কারখানার শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার।

জানা যায়, সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানার মালিক ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ নিয়ে তিন মাসের মজুরি দিয়েছেন। পরে জুলাইয়ের মজুরি দিতে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ সহায়তা পান কারখানা মালিকেরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তিন লাখ ১৯ হাজার ৬৮৬ জন। আর মৃত্যু হয়েছে চার হাজার ৩৮৩ জনের।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট দুই কোটি ৬১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন আট লাখ ৬৪ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।