করোনাভাইরাস: ইউরোপে আবার লকডাউন শুরু হলে সংকটে পড়বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক
2020.10.20
ঢাকা
তৈরি পোশাকের সর্ববৃহৎ বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো দ্বিতীয় দফার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে পুনরায় লকডাউনে গেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাতে আরেকবার কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হবে, যা চাকরি হারানোর আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে শ্রমিকদের।
গার্মেন্টস শ্রমিক নেতারা বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে চাকরি হারানো শ্রমিকদের কমপক্ষে দুই লাখ এখনো কাজ ফিরে পাননি।
জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট আমিরুল ইসলাম আমিন বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। তবে, আগস্টের শেষ দিক থেকে বিভিন্ন কারখানায় আবার শ্রমিক নিয়োগ শুরু হয়েছে। প্রায় এক লাখ শ্রমিক পুনরায় কাজ পেয়েছেন।”
তিনি বলেন, “এখনও দুই লাখের মতো শ্রমিক কোনো কাজ পাননি।”
আমিরুল বলেন, যারা কাজ হারিয়েছেন তাঁদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ কর্মীর চাকরির বয়স এক বছরের কম। আইন অনুযায়ী, যাদের চাকরির মেয়াদ এক বছরের কম তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না।
“দুঃখের বিষয় হলো, যাদের অভিজ্ঞতা ১০ থেকে ১৫ বছর তাঁদের অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। তৈরি পোশাক খাতে ভবিষ্য তহবিলের (প্রভিডেন্ট ফান্ড) ব্যবস্থা না থাকায় একটু বেশি বেতন পেলেই নিয়মিত চাকরি পরিবর্তন করে থাকেন কর্মীরা। এমনও উদাহরণ আছে চাকরি নেয়ার ছয় মাসের মাথায় করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে কোনো সুযোগ সুবিধা ছাড়াই শ্রমিকদের বাদ দেয়া হয়েছে,” বলেন আমিরুল।
তিনি বলেন, “করোনভাইরাস সংক্রমণ প্রকট হলে আরও শ্রমিক চাকরি হারাবেন।”
তৈরি পোশাক কারখানার মালিকেরা বলছেন, আগস্টের শেষ থেকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশে কার্যাদেশ আসতে থাকে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে।
তবে এ মাস থেকে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসহ অন্যান্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছে। অনেক দেশই লকডাউনে যাচ্ছে।
বাংলাদেশেও দ্বিতীয় দফা করোনা সংক্রমণ শুরুর ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নাগরিকদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে বলছেন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮৩ ভাগ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে দেশের মোট ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির মধ্যে এই খাত থেকে আসে প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের প্রায় ৬২ ভাগ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তবে এক দেশ হিসাবে সর্ববৃহৎ বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সরকারি হিসেবে, এই খাতে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ৪৫ লাখ কর্মী, যাদের অধিকাংশই নারী।
‘কাল চাকরি থাকবে কি না জানি না’
মহামারি শুরুর পর প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন জানিয়ে সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির প্রধান কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, “যেসব কারখানা সাব-কন্ট্রাকটের কাজ করে সেগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সেখানকার কর্মীরা চাকরি হারিয়েছেন। পরে তাঁদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক শ্রমিক চাকরি ফিরে পেয়েছেন।”
বর্তমানে কর্মীদের মাঝে চাকরি হারানোর ভয় মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে জানিয়ে কল্পনা বলেন, "এই সুযোগে মালিকপক্ষ তাঁদের দিয়ে বেশি বেশি কাজ করিয়ে নিচ্ছেন।”
কর্মীরা এখন নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না বলেও জানান কল্পনা।
“আমরা ছয়জন এক ঘরে থাকতাম। আমাদের তিনজনের চাকরি নাই,” জানিয়ে রাজধানীর মিরপুর-১১ এলাকার একটি কারখানায় কর্মরত শ্রমিক শিল্পি আক্তার বেনারকে বলেন, “কখন কার চাকরি যায় বলা যায় না। জানি না কালকে আমার চাকরি থাকবে কি না।”
তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত যে মাসের বেতন সেই মাসেই পাচ্ছি। কিন্তু কোনো ওভারটাইম নেই। ওভারটাইম ছাড়া স্বল্প বেতনে চলা কঠিন।”
করোনাভাইরাস শুরু হবার পর প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়ে যায় বলে বেনারকে জানান তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, “আগস্টের পর থেকে পুনরায় কার্যাদেশ আসতে থাকে। এখন পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো। যারা চাকরি হারিয়েছেন তাঁরা পর্যায়ক্রমে চাকরি পাচ্ছেন।”
“তবে পুনরায় ইউরোপ-আমেরিকায় লকডাউন দেখা দিলে সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে,” বলেন সিদ্দিকুর রহমান।
“তৈরি পোশাকখাতে ৪৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে দুই লাখ চাকরি যাওয়া মানে শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষের চাকরি যাওয়া। এটি শতকরা হারে খুব বেশি নয়,” মন্তব্য করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বেনারকে বলেন, “তবে, সংখ্যার দিক দুই লাখ চাকরি বিশাল ব্যাপার।”
“ইউরোপ-আমেরিকায় যদি দ্বিতীয় দফায় কঠোর লকডাউন দেয়া হয় তাহলে আরও কর্মী চাকরি হারাবে। দেশে মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে,” বলেন চুন্নু।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের মতে করোনা মহামারির আগে থেকেই তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকরা চাকরি হারাতে শুরু করেন।
তিনি বলেন, “এর অন্যতম কারণ হলো আমাদের তৈরি পোশাক খাতে আধুনিক মেশিনের ব্যবহার।”
যদিও তাঁর মতে, “কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে বিরাট ধাক্কা লাগে।”
করোনার কারণে কাজ হারানো সবাই চাকরি ফেরত না পাবার কারণ হিসেবে ড. সেলিম বলেন, বর্তমানে অনেক কারাখানা চালু থাকলেও নিজেদের সামর্থ্যের শতকরা মাত্র ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কাজ করছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে আবার লকডাউন শুরু হলে “আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তবে মনে হচ্ছে, প্রথমবারের মতো পুরোপুরি লকডাউনে যাবে না ওইসব দেশ।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ৯১ হাজার ৫৮৬ জন, মৃত্যু হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৯৯ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন চার কোটি ছয় লাখ ১২ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ১১ লাখ ২১ হাজারের বেশি।