করোনাসহ অন্যান্য ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইন্সটিটিউট স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার জাতীয় সংসদে সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় এক দশক আগে দেশে ডিপিটিসহ বিভিন্ন টিকা উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের ঘোষণা দেশের জন্য মঙ্গলজনক।
এই টিকা ইন্সটিটিউট স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। সবকিছু ঠিক থাকলে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যেই টিকা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, “করোনা ভাইরাসসহ বিভিন্ন ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং ভ্যাকসিন নীতিমালা প্রণয়নের পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের রয়েছে।”
তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকোচন, ভ্যাকসিন বৈষম্য প্রভৃতি বিশ্বের অনেক দেশেরই উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে।”
গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে তাঁর দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি এটাও বলে এসেছি, আমরা নিজেরা ভ্যাকসিন তৈরি করতে চাই। ভ্যাকসিন তৈরি করার যে প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলি আপনাদের সরিয়ে দিতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নতুন আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশেই নতুন ভ্যাকসিন উৎপাদন করা সহজতর হবে। ফলে দেশে স্বল্প মূল্যে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে।”
এ ছাড়া টিকা ইনস্টিটিউট হলে নতুন ভ্যাকসিনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রিকোয়ালিফিকেশন অর্জনের পথ সহজ হবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এটি বাংলাদেশে উৎপাদিত টিকার বৈদেশিক বাজার সম্প্রসারণে সহায়ক হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে যাতে করোনাভাইরাস টিকা উৎপাদন করা যায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে গোপালগঞ্জে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড এই টিকা উৎপাদন করবে।”
যত দ্রুত সম্ভব করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ঘোষণা বাস্তবায়নযোগ্য
সরকারের এই ঘোষণাকে বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছরের মার্চ মাসে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে টিকা পেতে বেশ বেগ পেতে হয় বাংলাদেশকে। টিকার সংকট শুরু হওয়ায় চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বাংলাদেশ। এর আগে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটকে অগ্রিম অর্থ দেয়ার পরও নির্ধারিত তিন কোটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা বাংলাদেশ পায়নি।
যদিও টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবরে বুধবার বলা হয়, ভারত নিজ দেশে এক বিলিয়ন ডোজ টিকা দেওয়ার পর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশে আবার টিকা রপ্তানি শুরু করেছে।
ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজেদের টিকা উৎপাদন করা উচিত বলে মনে করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন।
করোনাভাইরাসের টিকাসহ যে কোনো টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে কীভাবে এই টিকা প্রস্তুত করা হবে সেটি না জেনে বলা যাবে না স্থানীয়ভাবে কতদিনের মধ্যে এই টিকা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে টিকা উৎপাদনে খরচ বেশি। বিদেশ থেকে স্বল্প খরচে টিকা ক্রয় করা সম্ভব এই যুক্তিতে টিকা উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাদের অবস্থা হলো, নিজের জমিতে চাষ না করে অন্যের কাছ থেকে চাল কিনে খাওয়ার মতো।”
“যদি বিশ্বের অন্যান্য কোম্পানির সাথে যৌথভাবে টিকা প্রস্তুত করা যায় সেটি ভালো হবে। আমাদের টিকা উৎপাদন করা উচিত,” বলেন মোশতাক হোসেন।
তাঁর মতে, বাংলাদেশের গরম আবহাওয়ায় নষ্ট হবে না, এমন টিকা উৎপাদন করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচ) ড্রাগ বিভাগের সাবেক প্রধান ড. আবু বক্কর সিদ্দিক বুধবার বেনারকে বলেন, “ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ ডিপিটিসহ বিভিন্ন টিকা উৎপাদন করত। এই টিকাগুলো দেশের চাহিদার একটি বড়ো অংশ মেটাত। কিন্তু গত এক দশক আগে টিকা উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়।”
তবে প্রধানমন্ত্রী টিকা উৎপাদনের যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটির বাস্তবায়ন সময় সাপেক্ষ এবং এর জন্য দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো দরকার জানিয়ে ড. সিদ্দিক বলেন, “এছাড়াও করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন দরকার।”
দেশে দ্রুত করোনাভাইরাস টিকা উৎপাদনের জন্য সরকারি মালিকানাধীন এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড বিদেশি কোনো উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে “টিকা কনসেনট্রেটেড আকারে এনে স্থানীয়ভাবে বোতলজাত এবং বিতরণ করতে পারে,” বলে মনে করেন তিনি।
“তবে যদি আমরা সবকিছু দেশে প্রস্তুত করতে পারি সেটি হবে একটি বড়ো অর্জন,” বলেন ড. সিদ্দিক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি ৩৮ লাখ মানুষ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন এবং পাঁচ কোটি ২৫ লাখের বেশি মানুষ এক ডোজ টিকা নিয়েছেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে ১৩ কোটির বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের মানুষকে করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় ২১ কোটি টিকা কেনা হয়েছে। এরই মধ্যে সাড়ে ১১ কোটি টিকা দেশে এসেছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণে মোট ছয় জন মারা গেছেন বলে বুধবার জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই সময়ে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন ২৬৬ জন।
অধিদপ্তরের হিসাবে এখন পর্যন্ত সারাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৭ হাজার ৯৩৪ জন। মোট শনাক্ত সংখ্যা ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ২১৪ জন।