বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বছরের শুরুতেই আসতে পারে করোনাভাইরাসের নতুন ঢেউ
2021.12.30
ঢাকা
নতুন বছরের শুরুর আগেই গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মাসের শুরুর দিকে যেখানে নমুনার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল শতকরা এক ভাগ, বৃহস্পতিবার সেই হার দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের আরেকটি ঢেউ শুরু হতে পারে, চলতি বছর এই বৃদ্ধি শুরু হয় মার্চে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদেশ থেকে আসা লোকজন কোনো ধরনের কোয়ারেন্টাইন ছাড়াই তাঁরা জনসাধারণের সাথে মিশে যাওয়াকে এর মূল কারণ বলে মনে করছেন তাঁরা।
সংক্রমণ বৃদ্ধির এই প্রবণতার মধ্যে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বৃহস্পতিবার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত মঙ্গলবার সারাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৯৭ জন। বুধবার সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৫তে, বৃহস্পতিবার শনাক্ত হন ৫০৯ জন রোগী।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক আহমেদের মতে, “গত কয়েকদিনের প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে নতুন বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকবে।”
দেশে “প্রতিদিনই শনাক্ত বাড়ছে,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “কিছুদিন আগেও দৈনিক শনাক্তের হার শতকরা এক ভাগের সামান্য বেশি ছিল। আজকে সেই হার দুই দশমিক ২৫ হয়েছে। মনে হচ্ছে আরেকটি ঢেউ আগেই শুরু হয়ে গেলো।”
তাঁর মতে, “সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষের বাংলাদেশে আসা। গত দুই মাস ধরে সারাবিশ্ব থেকে দলে দলে মানুষ বাংলাদেশে আসছেন। বিমানবন্দরে প্রচুর ভিড়।”
“যারা বিদেশ থেকে আসছেন, তাঁরা কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন না। কেউ কেউ সরাসরি সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছেন। অথবা বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ, করোনাভাইরাসে প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ।
সে বছর জুন-জুলাই মাসে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ২ জুলাই দৈনিক সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। সেই ধাপে ৩০ জুন দিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন প্রাণ হারান। আগস্ট থেকে প্রথম ঢেউয়ে সংক্রমণ কমতে থাকে। ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। এবং এই দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে বেশি গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়।
২০২১ সালের ২৮ জুলাই দেশের ইতিহাসে দৈনিক সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন। ১০ আগস্ট দৈনিক সর্বোচ্চ ২৬৪ জন করোনাভাইরাসে প্রাণ হারান। তবে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সংক্রমণের হার ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে।
সেপ্টেম্বর থেকে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার কমতে থাকে। ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬৬ জন। এই কমতির ধারা পুরো নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
তবে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ শুরু থেকে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে
দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের অতিসংক্রমিত ওমক্রিন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় ইউরোপ-আমেরিকায় নতুন করে জনসমাগমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কমপক্ষে সাত জনের শরীরে ওমিক্রন ধরা পড়েছে বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
“তবে সংক্রমণের মাত্রা খুবই মৃদু,” জানিয়ে তিনি বলেন, “তাঁরা সবাই ভালো আছেন।”
করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের বিস্তার ঘটার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বেশ কিছু দেশে বিধিনিষেধ আরোপ করছে দেশগুলোর সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সংক্রমণ বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকলে পুনরায় লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ আসতে পারে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের মতো রপ্তানিকারক দেশ।
বাংলাদেশে যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণ নতুন করে খুব বেশি না ছড়ায় তাহলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে খুব বেশি সমস্যা হবে না, জানিয়ে তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অর্ডার নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি।”
“আমাদের রপ্তানির বাজার মূলত ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। সেখানে যদি বিধিনিষেধ আসে তাহলে আমরা সমস্যায় পড়ে যাব,” বলেন তিনি।
বিজিএমইএ’র হিসাবে প্রতিবছর বাংলাদেশে যে পরিমাণ রপ্তানি হয় এর শতকরা ৮৩ ভাগ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এবং বাংলাদেশে থেকে মোট রপ্তানিকৃত পোশাকের সবচেয়ে বড়ো বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা ও ব্রিটেন।
এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেলে স্কুলগুলো হয়তো চালু রাখা সম্ভব হবে না। সে কারণে, অনলাইন শিক্ষাটা যাতে প্রত্যেক ঘরে পৌঁছায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
শেখ হাসিনা সবাইকে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেব্রিনা ফ্লোরা বেনারকে জানান, দেশে পাঁচ কোটি ১৮ লাখের বেশি মানুষ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন।
এপ্রসঙ্গে মোশতাক হোসেন বলেন, “দেশের প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ দুটি ডোজ অথবা একটি ডোজ নিয়েছেন। এছাড়া শতকরা ১০ ভাগ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে এন্টিবডির মাধ্যমে সুরক্ষিত।”
“তবে মনে রাখতে হবে এখনও শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ টিকার বাইরে। সুতরাং, যেকোনো মুহূর্তে সমস্যা হতে পারে,” বলেন মোশতাক হোসেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে সারাদেশে এপর্যন্ত ১৫ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন ২৮ হাজার ৭০ জন।