সূচক বাড়লেও বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনক

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক
2017.01.25
দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০১৬ প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল। দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০১৬ প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল। জানুয়ারি ২৫, ২০১৭।
স্টার মেইল

বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে সামান্য উন্নতি করলেও অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকা থেকে এবারও বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। অবস্থা এমন যে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমনে ভালো করছে, না মন্দ করছে তা বোঝা মুশকিল।

বুধবার ২০১৬ সালের দুর্নীতির আন্তর্জাতিক ধারণাসূচক প্রকাশ করে বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)।

এই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর এবার ১ পয়েন্ট বেড়ে ২৬ হয়েছে। একই স্কোর পেয়ে সূচকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পঞ্চদশ অবস্থানে রয়েছে ক্যামেরুন, গাম্বিয়া, কেনিয়া, মাদাগাস্কার ও নিকারাগুয়া।

২০১৬ সালের সূচক অনুযায়ী বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৭৬টি দেশের মধ্যে ৬৯ শতাংশ দেশই ৫০ এর কম স্কোর পেয়েছে।

এখানে শূন্য স্কোর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোর সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশকে নির্দেশ করে।

টিআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত সোমালিয়ার স্কোর এবার ১০। এরপরে রয়েছে যথাক্রমে দক্ষিণ সুদান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সুদান, আফগানিস্তান, ভেনেজুয়েলা ও ইরাক।

অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর পেয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশের তালিকার শীর্ষে যৌথভাবে অবস্থান করছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। এর পরে রয়েছে ফিনল্যান্ড (৮৯ স্কোর), সুইডেন (৮৮ স্কোর), সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ ও যুক্তরাজ্য।

এবার বিশ্বের ১৭৬টি দেশের দুর্নীতির সূচক ধরে তালিকা করেছে টিআই। গতবারের তালিকায় ছিল ১৬৮টি দেশ।

বাংলাদেশের অবস্থান

ভালোর দিক থেকে গুনলে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৪৫ নম্বরে। গতবার বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৯ নম্বরে। অর্থাৎ ছয় ধাপ অধঃপতন হয়েছে।

এই অবস্থান ব্যাখ্যা করে টিআই এর বাংলাদেশ শাখার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে না বেড়েছে তা বলা কঠিন।”

“স্কোরের দিক থেকে সামান্য অগ্রগতি হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন হওয়ায় দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখনো উদ্বেগজনক,” মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ দুর্নীতিতে এর আগে ২০০১ সাল থেকে টানা পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল৷

দুর্নীতির আন্তর্জাতিক ধারণা সূচক প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির বাংলাদেশ শাখার চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল বলেন, “দুর্নীতির ক্ষেত্রে খুশি হওয়ার মতো অবস্থানে নেই আমরা। একটা জায়গায় আটকে আছি। আমাদের অবস্থানের পরিবর্তন করতে পারছি না আমরা।”

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশের আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি কাঠামো তুলনামূলকভাবে সুদৃঢ় হয়েছে। এই ধারণা থেকে সূচকে বাংলাদেশের স্কোর এক পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ঘাটতির কারণে আমরা আরও ভালো করতে পারিনি।’

দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আছে আফগানিস্তান। তাদের স্কোর মাত্র ১৫। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান; স্কোর ২৬।

এ অঞ্চলে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান। এ বছর দেশটির স্কোর ৬৫ এবং ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থান ২৭। এরপর ৪০ স্কোর নিয়ে ৭৯ তম অবস্থানে রয়েছে ভারত।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৩৬ স্কোর পেয়ে ৯৫ তম অবস্থানে যৌথভাবে অবস্থান করছে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা। ৩২ স্কোর পেয়ে ১১৬ তম অবস্থানে পাকিস্তান আর ২৯ স্কোর পেয়ে ১৩১ তম অবস্থানে রয়েছে নেপাল। এরপর ২৬ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৫ তম।

কী পরিমাণ দুর্নীতি বাংলাদেশে

বাংলাদেশে মোট কী পরিমাণ দুর্নীতি হয় তার স্পষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খানের মতে বাংলাদেশের উন্নয়ন বহুলাংশে আটকে আছে দুর্নীতির কারণে।

তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে যে পরিমাণ ঘুষ লেনদেন হয় তা বছরে কম হলেও ৩০ হাজার কোটি টাকা৷ শুধু ঘুষের মধ্যেই দুর্নীতি সীমাবদ্ধ নেই। বহু প্রকার দুর্নীতি আছে। এর জরিপ করা মুশকিল।”

গেল বছর টিআইবির এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ ১৬টি খাতের সেবা পেতে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।

মন্ত্রীরা অসহায় কেন?

দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সাম্প্রতিককালে কয়েকজন মন্ত্রীর অসহায়ত্ব প্রকাশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন সুলতানা কামাল ও ইফতেখারুজ্জামান। অসহায়ত্ব প্রকাশকেও ‘এক ধরনের দুর্নীতি’ বলে তারা অভিহিত করেছেন।

সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা দুর্নীতিতে রাজনৈতিক প্রভাব দেখতে পাই। দেখা যায়, প্রভাবশালীরা নদী দখল করছে, আর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান বলছেন, যারা নদী দখল করে তারা এত প্রভাবশালী যে তাদের ওঠানো যায় না।”

“তারা কীসের ভিত্তিতে অসহায় বোধ করেন? এটাও দুর্নীতি। রাজনৈতিক শক্তির সরাসরি আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এ ঘটনা ঘটতে পারে না,” মনে করেন সুলতানা কামাল।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ব্যাংকিং দুর্নীতির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই, অনেক সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, সব পানির মতো পরিষ্কার কিন্তু কিছুই করতে পারেন না তিনি। এ ছাড়া বড় বড় ঋণ খেলাপিদের কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া হয়–সেটা আমরা জানি। সবকিছুর ভেতরেই একটা রাজনৈতিক শক্তি কাজ করে।”

টিআই’র দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থান প্রসঙ্গে মতামত জানতে চেয়ে বুধবার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহানের মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।