বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল

জেসমিন পাপড়ি
2019.01.29
ঢাকা
190129_TI _Corruption_index_620.JPG সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ২৯ জানুয়ারি ২০১৯।
[সৌজন্যে: টিআইবি]

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থানের ছয় ধাপ অবনমন ঘটেছে। বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় ওপরের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯। ২০১৭ সালে যা ছিল ১৪৩।

মঙ্গলবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে একযোগে ঢাকার ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

বাংলাদেশের এই অবনমন ‘বিব্রতকর’ বলে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান বৈশ্বিক অবস্থানের চেয়ে অনেক নিচে। এখানে আত্মতুষ্টির কোনো অবস্থা নেই।”

বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক জানিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।

তবে টিআই’র এই প্রতিবেদন মানতে রাজি নয় বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বর্তমানে বাংলাদেশে দুর্নীতির পরিস্থিতি ‘নিম্নগতির দিকে’ বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

যদিও দেশের প্রকৃত চিত্রই টিআই’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “দুর্নীতি আমাদের সমাজে ব্যাপক এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে এটা স্পষ্ট। এর স্বীকারোক্তি স্বরূপই ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা আশা করব, এই জিরো টলারেন্সের ঘোষণা বাস্তবে রূপান্তরিত হবে। এর জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের জনশ্রুতি আছে জরুরি ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে ক্ষমতার কাছাকাছি যারা আছে।”

“এই সরকার গত ১০ বছর ক্ষমতায় থাকায় তাদের আশপাশের অনেকেই হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে দুর্নীতির ফলে। সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। না হলে এই অঙ্গীকারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে,” মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, একাদশ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলছে। গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদের ঘোষণা দেন।

দুর্নীতি বাড়ার কারণ

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান দুর্নীতি বৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বলেন, “দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার বা রাজনৈতিক ঘোষণা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ হয় না। বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের প্রশাসন ও রাজনীতিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ব্যাপকভাবে বিদ্যমান।”

“এ ছাড়া আমাদের ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে দুর্নীতির যে বিচারহীনতা, সারা দেশে ভূমি, নদী, জলাশয় দখলের যে প্রবণতা, রাষ্ট্রীয় ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, ক্রমবর্ধমান এবং বিব্রতকরভাবে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অর্থ পাচার এবং রাষ্ট্রীয় নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক যে প্রভাব সেগুলোও আমাদের ভালো স্কোর না হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে,” বলেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদক ও অন্যান্য জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। গণমাধ্যম ও নাগরিক প্রতিষ্ঠানের কাজের ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগতভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুদকের কাজ নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে সীমাবদ্ধ, উচ্চ পর্যায়ে নেই।

তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কৌশল প্রণয়ন অপরিহার্য। সংসদকে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার। আসামিদের পরিচয় ও রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

দুদকের প্রতিক্রিয়া

টিআই কীসের ভিত্তিতে বাংলাদেশে দুর্নীতির হিসাব করেছে, সে তথ্য-উপাত্ত জানতে চেয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

টিআই’র প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “টিআইকে আমরা আগেও বলেছি যে, আপনারা আপনাদের রিপোর্টের ম্যাথডলজি আমাদের জানান এবং ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগার দিয়ে কথা বলেন।”

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা পত্রিকায় দেখেছি এই সংখ্যা, নাম্বার। এই নাম্বারই যথেষ্ট না। আপনাকে ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগার দিয়ে বলতে হবে, দুর্নীতি এইভাবে হয়েছে।”

ইকবাল মাহমুদ বলেন, “দুর্নীতি বাড়ার কারণ কী? সেই কারণগুলো অ্যাড্রেস করার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেসব যদি রিপোর্টে না থাকে, তাহলে এই রিপোর্ট কোনোভাবেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।”

সারাদেশে দুর্নীতির ব্যাপারে জনসাধারণ সচেতন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই সচেতনতায় প্রমাণ করে যে দুর্নীতি আসলে নিম্নগতির দিকেই।”

টিআইয়ের গবেষণা পদ্ধতিরও সমালোচনা করেন দুদক চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, “আজ পর্যন্ত আমরা কখনো বলিনি যে আমরা স্বাধীন নই। আমরা অ্যাবসলিউটলি স্বাধীন। সেই কারণে আইনি ম্যান্ডেট নিয়ে যাচ্ছি, কেউ তো আমাদের বাধা দিচ্ছে না।”

তবে দেশের বড় দুর্নীতিবাজদের ধরতে না পারার সমালোচনা মেনে নেন ইকবাল মাহমুদ।

বাংলাদেশের অবস্থান

টিআই সূচকে শূন্য স্কোরকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসনের দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

এবারের সমীক্ষায় দুই তৃতীয়াংশের বেশি দেশের স্কোর ৫০ এর নিচে, আর ১৮০টি দেশের গড় স্কোর ৪৩ বলে জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

এই সূচকে ১০০-র মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। অধঃক্রম অর্থাৎ খারাপ থেকে ভালো ক্রমানুসারে ১৩তম অবস্থানে এসেছে। যা ২০১৭ সালে ছিল ১৭তম। টিআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে কেবল আফগানিস্তান। অধঃক্রম অনুযায়ী দেশটির অবস্থান এবার নবম।

টিআই এর তালিকায় ১০ স্কোর নিয়ে এবারও সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া; গতবারের তুলনায় ১ পয়েন্ট বাড়লেও অবস্থানের বদল হয়নি দেশটির। সোমালিয়ার পরে রয়েছে যথাক্রমে সিরিয়া, সাউথ সুদান, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া, সুদান, গিনি-বিসাউ, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, আফগানিস্তান ও লিবিয়া।

তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থান ডেনমার্কের, তাদের স্কোর ৮৮, এটাই সর্বোচ্চ স্কোর। স্কোর কমার কারণে গতবারের তালিকায়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা নিউজিল্যান্ড এবার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এরপরেই রয়েছে ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, কানাডা ও লুক্সেমবুর্গ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।