সাঁওতালদের ঘরে পুলিশ আগুন দিয়েছে কিনা, তা জানতে চায় হাইকোর্ট

জেসমিন পাপড়ি
2016.12.14
ঢাকা থেকে
161214-BD-fire-620.jpg গোবিন্দগঞ্জে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়া হয়। নভেম্বর ০৬, ২০১৬।
স্টার মেইল

আপডেটঃ ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ইস্টার্ন টাইম সকাল ১১.০০

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়ার বিষয়টি তদন্ত করতে সেখানকার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। গতকাল বুধবার এ বিষয়টিসহ সাঁওতালদের ঘটনায় কমপক্ষে তিনটি নির্দেশ দিল উচ্চ আদালত।

হাইকোর্টের দেওয়া এই আদেশে সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার সঙ্গে পুলিশ জড়িত কিনা এবং কারা ওই ঘটনায় জন্য দায়ী—তা খতিয়ে দেখে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কমপক্ষে পুলিশ সুপার মর্যাদার কর্মকর্তার মাধ্যমে এই তদন্ত তদারকের ব্যবস্থা করতেও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।​

গোবিন্দগঞ্জ চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে পুলিশের আগুন দেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরে, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) একটি সম্পূরক আবেদন করেছিল। এর প্রেক্ষিতে এই আদেশ দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।

‘খানিকটা দেরিতে’ হলেও বিচারিক হাকিমের মাধ্যমে তদন্ত করার এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালরা। তদন্তের মাধ্যমে সত্য প্রকাশের ফলে দোষীদের শাস্তির পাশাপাশি নিজেদের হারানো সম্পত্তি ফিরে পাবেন বলেও আশা করেন তাঁরা।

হাইকোর্টের আদেশে উচ্ছেদের সময় ভাঙচুর, লুটপাট ও হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা একটি এজাহার ও একটি জিডি মামলা হিসেবে গ্রহণ করে সমান গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদালতের রায় প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট আবু ওবায়দুর রহমান বেনারকে বলেন, “সাঁওতালদের ঘরে পুলিশ আগুন দিয়েছিল-বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন নজরে আনার পর আদালত গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে৷ আগামী ১৫দিনের মধ্যে এ প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।”

এদিকে ঘটনার প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় পরে মুখ্য বিচারিক হাকিমকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেওয়াকে ‘যথেষ্ট বিলম্ব’ বলে মনে করছেন সাঁওতালরা। তবে দেরিতে হলেও উচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাসকে বেনারকে বলেন, “শুরু থেকেই আমরা এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে আসছি। আদালতের এ সিদ্ধান্ত যথেষ্ট বিলম্বে নিয়েছেন। তবুও আমরা সন্তুষ্ট।”

তিনি বলেন, “সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হবে পুলিশ, স্থানীয় সাংসদ এবং চেয়ারম্যানের লাঠিয়াল বাহিনী মিলে আমাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে।”

আদালতের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরাও।

এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “আশা করি, এ তদন্তের মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।”

তদন্তে পুলিশের অপরাধের প্রমাণ পেলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে ঘটনার প্রায় দেড় মাসেও নিরাপত্তাহীনতা কাটেনি সাঁওতালদের। বিভিন্ন সংগঠনের সাহায্য সহযোগিতায় খেয়ে পরে বাঁচলেও মাথার ওপরে এখনো ছাদ নেই তাদের। কাঁটাতারের ভেতরে এক ধরনের বন্দী জীবন যাপন করছেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে ফিলিমিন বাসকে বলেন, ঘটনার পরপরই প্রায় তিন-চার কিলোমিটার আদিবাসী এলাকা জুড়ে একটি কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়। হঠাৎ সে বেড়ার কিছু অংশ পড়ে গেছে, কিংবা কেউ ফেলে দিয়েছে। যা নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ।

তিনি বলেন, “আমরা কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে বলতে গেলে খোলা আকাশের নিচে বাস করছি। বিভিন্ন সংগঠন নিত্য দিনের খাবার দিয়ে সাহায্য করছে। তবে আমরা আশায় আছি নিজেদের বাসস্থান আবার ফিরে পাওয়ার।”

প্রসঙ্গত, গত ৬ নভেম্বর সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা বিরোধপূর্ণ জমি থেকে কয়েকশ সাঁওতাল পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। সে সময় দুপক্ষের মাঝে সংঘর্ষ বাঁধে এবং সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট, ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়।

চিনিকল শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালালে তিনজন সাঁওতাল নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এনে গোবিন্দগঞ্জ থানায় ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং তিন থেকে চারশজনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা করা হয়। এদের মধ্যে চারজন সাঁওতালকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, যাঁদের তিনজন হাতকড়া পরা অবস্থায় চিকিৎ​সাধীন ছিলেন। পরে হাইকোর্ট তাঁদের হাতকড়া খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

অপর এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে সাঁওতালদের লাগানো ধান কেটে নিতে সহায়তা করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশও দেয় আদালত।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের দিকে তৎকালীন সরকার গোবিন্দগঞ্জে এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে । তখনই এ সব জমির মালিকদের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল, চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ ছাড়া ওই জমিতে অন্য কোনো ফসল চাষের জন্য ইজারা দিতে পারবে না।

তবে চিনিকল কর্তৃপক্ষ অন্য ফসল চাষের জন্য জমি ইজারা দিয়েছে বলে অভিযোগ করে স্থানীয়রা। আর এর  প্রতিবাদ হিসেবে সাঁওতালেরাও ওই জমিতে ঘরবাড়ি তুলে বসবাস করছেন। সেসব বাড়িঘর উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে গত ৬ নভেম্বর প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধে।

 ফেইসবুকে প্রকাশ হওয়া ভিডিওর স্ক্রিনশট। ফাইল ফটো।
ফেইসবুকে প্রকাশ হওয়া ভিডিওর স্ক্রিনশট। ফাইল ফটো।

ঘটনার প্রায় এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা একটি ভিডিওর ভিত্তিতে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, সাঁওতাল পল্লীর ভেতরে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুঁড়ছেন। কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটি ঘরে লাথি মারছেন এবং পরে এক পুলিশ সদস্য ওই ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেন।

পুলিশ আগুন দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।