সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার গ্রামের বাড়িতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.01.06
ঢাকা
200106_BD_SK_Sinha_620.jpg দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া রওয়ানা দেবার আগ মুহূর্তে নিজের সরকারি বাসভবনের গেটে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ১৩ অক্টোবর ২০১৭।
[নিউজরুম ফটো]

দেশের বাইরে অবস্থান করা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহার) বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সোমবার মৌলভীবাজার জেলায় তাঁর পৈতৃক বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। এর আগের দিনই দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে এই পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েস।

বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম। একই সাথে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ভুয়া ব্যবসায়িক ঋণ সৃষ্টি করে চার কোটি টাকা পাচারে এসকে সিনহাকে সহায়তার দায়ে আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে তাঁদের স্থায়ী ঠিকানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

অভিযুক্ত ১১ আসামি হাজির না হলে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁদের অনুপস্থিতিতে বিচারের জন্য আদালতে আবেদন করবে বলে জানান মীর আহমেদ।

দেশের ইতিহাসে এসকে সিনহাই প্রথম প্রধান বিচারপতি যিনি দুর্নীতির দায়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন।

বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা বলছেন, এসকে সিনহার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। তবে সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, “সাবেক ফার্মার্স ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা পাচারের দায়ে এসকে সিনহা এবং আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে আমাদের চার্জশিট রোববার গ্রহণ করেছেন আদালত। আসামিদের সবাই পলাতক রয়েছেন।”

তিনি বলেন, “আদালতের আদেশ অনুযায়ী, সোমবার এসকে সিনহার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাঁর স্থায়ী ঠিকানা মৌলভীবাজার জেলায় পাঠানো হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা না গেলে পরবর্তী শুনানির দিন ২২ জানুয়ারি বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হবে।”

আইনজীবী বলেন, “প্রয়োজনে আমরা এসকে সিনহার সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ চাইব। তারপরেও তিনি অনুপস্থিত থাকলে, তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার চালানোর আবেদন করা হবে।”

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তাঁর প্রভাবের কারণে নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ও মো. শাহজাহানের জন্য বরাদ্দকৃত ভুয়া ঋণের টাকা এসকে সিনহার নামে দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ইস্যু করে ফার্মার্স ব্যাংক। সেই পে-অর্ডার দুটি সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এসকে সিনহার ব্যক্তিগত হিসাবে জমা দেয়া হয়।”

সালাম আরও বলেন, “এসকে সিনহা সেই চার কোটি টাকা বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে তাঁর পছন্দের বিভিন্ন জনের কাছে পাঠিয়ে দেন। আমাদের মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী, এই ধরনের অর্থ লেনদেন অর্থ পাচারের শামিল। এই অপরাধের জন্য তাঁর সর্বোচ্চ ১২ বছর জেল হতে পারে।”

“ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়ে তিনি প্রভাব খাটাতে পারেন না। এর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। সে কারণে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের আওতায় তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ এনেছি।”

সালাম জানান, “ফৌজদারি বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।”

‘সরকারের বিরোধিতা করার জন্য হয়রানি’

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ বেনারকে বলেন, “দুর্নীতির কারণে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাঁর এ ধরনের কাজে জড়ানো উচিত হয়নি। আইন সকলের জন্য সমান। তাই, তাঁকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।”

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব হোসেন বেনারকে বলেন, “সংবিধান সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে সরকারের বিরাগভাজন হন জনাব সিনহা। এই রায়ের পর তাঁকে দেশ ত্যাগ করতে হয় এবং এখন তাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হচ্ছে।”

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মাহবুব বলেন, “সেই অভিযুক্ত মানি লন্ডারিং হয়েছে ২০১৬ সালে। যদি সরকারের কাছে তথ্য থাকত তাহলে তারা সেই সময় সংবিধানের আলোকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাঁর বিচার করতে পারত।”

তিনি বলেন, “তা না করে এভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে বিচার করার কারণে জনসাধারণের ধারণা হলো, সরকারের বিরোধিতা করার জন্য তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে এভাবে হয়রানি করা ঠিক নয়। অধিকাংশ আইনজীবী বিষয়টি সমর্থন করেন না।”

তাঁর মতে, “যদি জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচার করা হতো তাহলে সরকারকে বিশ্বাস করত জনগণ।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বেনারকে বলেন, “সরকার তাঁকে হয়রানি করছে কথাটা সম্পূর্ণ অসত্য। তিনি অপরাধ করেছেন এবং স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে।”

দুদকের অভিযোগ

দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগ অনুযায়ী, এসকে সিনহার ‘কাছের লোক’ আসামি মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় দুইটি আলাদা হিসাব খোলেন।

তাঁরা ব্যবসার প্রসারের জন্য প্রথমে পাঁচ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করেন। তবে তারা কোনোদিন ব্যবসা করেননি বলে উল্লেখ করেছে কমিশন।

শাহজাহান ও নিরঞ্জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং ঋণের আবেদনে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, সেই বাড়ির মালিক ছিলেন এসকে সিনহা বলে উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।

ওই ঋণের আবেদনে জামানত হিসেবে এসকে সিনহার কাছের লোক আসামি রণজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রি রায়ের সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয়।

হিসাব খোলার পরদিনই ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করে ফার্মার্স ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারা কোনো ব্যাংকিং নিয়ম মানেননি বলে জানিয়েছে কমিশন।

দুটি পে অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা দ্রুত সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এসকে সিনহার ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে তিনি সেই টাকা বিভিন্ন জনের হিসাবে পার করে দেন।

২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী, এই কাজ সংঘবদ্ধ পাচার। এই অপরাধের জন্য আসামিদের সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।

দুদক বলছে, ঋণটি মঞ্জুর করতে এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতির পদের অপব্যবহার করে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ভঙ্গ করেছেন। আর এই অপরাধের জন্য তাঁর সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এসকে সিনহাই প্রথম সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য যিনি প্রধান বিচারপতি হন।

সংসদের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসন ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য সংসদে পাশ করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এসকে সিনহার।

সে কারণে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথমে ছুটি নিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়া যান। পরে দেশের বাইরে থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি।

তাঁর দেশ ত্যাগের পর দিন সুপ্রিম কোর্ট এক বিবৃতিতে জানায়, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ-পাচারসহ ১১টি অভিযোগ এসেছে। দুদক দুর্নীতির অভিযোগ করবে বলে সেদিনই ইঙ্গিত দেন আইন মন্ত্রী আনিসুল হক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।