ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে ভেবে কানাডায় আসার সিন্ধান্ত নিয়েছি: এসকে সিনহা

রনি টলডেন্স
2019.07.26
ওয়াশিংটন ডিসি
171013_CJ_story_620.jpg দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া রওয়ানা দেবার আগ মুহূর্তে নিজের সরকারি বাসভবনের গেটে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ১৩ অক্টোবর ২০১৭।
[ফোকাস বাংলা]

সরকারের সাথে বিরোধের জেরে দেশ ছাড়ার প্রায় দুই বছর পর কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন বাংলাদেশর সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। শুক্রবার টেলিফোনে বেনারকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন তিনি।

গত ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় প্রবেশ করে স্ত্রীসহ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন জানিয়ে বিচারপতি সিনহা বেনারকে বলেন, “আর কতদিন সেখানে ভাসমান অবস্থায় থাকব?”

কানাডায় বিচারপতি সিনহার এক মেয়ে বসবাস করেন। এর প্রেক্ষিতে “ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে ভেবে আমরা কানাডায় আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” বেনারকে জানান তিনি।

কানাডার মানবাধিকার পরিস্থিত তুলনামূলকভাবে উন্নত মন্তব্য করে তিনি জানান, কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ এখনো তাঁর আবেদনের বিষয়ে কিছু জানায়নি।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এসকে সিনহার (৬৮)। এরই জের ধরে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথমে ছুটি নিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়া যান। পরে দেশের বাইরে থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান।

বিচারপতি সিনহা দেশ ছাড়ার পর দিন সুপ্রিম কোর্ট এক বিবৃতিতে জানায়, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ-পাচারসহ ১১টি অভিযোগ এসেছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আপিল বিভাগের পাঁচজন বিচারক তাঁর সঙ্গে বিচারিক কাজ করবেন না বলে জানিয়েছেন।

একই দিন আইন মন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির তদন্ত করতে পারে দুর্নীতি দমন কমিশন।

এর প্রায় দুই বছর পর গত ১০ জুলাই ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বাংলাদেশে সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা এটাই প্রথম। এই মামলাকে “অনৈতিক ও অন্যায়” আখ্যা দিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, “সরকার অব্যাহতভাবে আমার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টায় রয়েছে।”

তবে “স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা দায়ের করেছে। এ বিষয়ে সরকারের কিছুই করার নেই,” বলে শুক্রবার বেনারকে বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী প্রণব কুমার ভট্টাচার্য শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমরা বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা দায়ের করেছি। এখন অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত হবে।”

“আইন অনুযায়ী মামলাটি চলবে। তিনি মামলা লড়েন বা না লড়েন, তাতে কিছু যায় আসে না,” জানান তিনি।

এদিকে নিজের বইয়ের প্রসঙ্গ টেনে মামলা সম্পর্কে বিচারপতি সিনহা বলেন, “সরকারের কদর্য আচরণগুলো প্রকাশ করে দেবার পর তারা বুঝতে পেরেছে ওগুলো তাদের মারাত্মক ভুল ছিল। তাই এখন তারা ওইসব ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করছে।”

দুদকের মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, “উত্তরার জমি বিক্রির টাকার এক অংশ দিয়ে আমি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছি, কিছু টাকা ফিক্সড ডিপোজিটে জমা করেছি, আর কিছু টাকা গ্রামের বাড়ি বানানোর কাজে লাগিয়েছি। সব কিছুই আমি ২০১৬-১৭ সালের আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেছি।”

“তাহলে দুর্নীতিটা কোথায় হয়েছে আজ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারলাম না,” বলেন বিচারপতি সিনহার।

“তাছাড়া ওই টাকার সবটাই এখনো দেশেই রয়েছে। তাহলে টাকা পাচারের বিষয়টা কীভাবে আসে?” প্রশ্ন করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় বিচারপতি সিনহা তাঁর আত্মজীবনী ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম- রুল অব ল, হিউমেন রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ প্রকাশ করেন।

এতে সরকারের পছন্দমতো রায় লিখতে রাজি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা এবং চাপ দিয়ে দেশত্যাগ ও পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ করেন তিনি।

একই সাথে তাঁকে চাপ ও হুমকি দেওয়ার জন্য সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকেও (ডিজিএফআই) আত্মজীবনীতে অভিযুক্ত করেন এসকে সিনহা।

“শেষ পর্যন্ত, আমার পরিবারের ওপর সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর চাপ ও হুমকির মুখে আমি দেশের বাইরে থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেই,” আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন বিচারপতি সিনহা।

তবে “সরকার তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে, বিচারপতি সিনহার এই অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়” বলে শুক্রবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তিনি বলেন, “মূলত, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা তাঁর দুর্নীতির বিরুদ্ধে একজোট হয়েছিলেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন, তাঁরা উনার সাথে কাজ করবেন না।”

মাহবুবে আলম বলেন, “বিচারপতি সিনহা সেই অভিযোগগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে বাকি বিচারপতিরা রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা বিচারপতি সিনহার সাথে কাজ করবেন না।”

“তখন সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, অন্য বিচারপতিরা বিচারপতি সিনহার সাথে কাজ করবেন না বলে জানিয়েছেন। এর পর তিনি (সিনহা) বিদেশে চিকিৎসার কথা বলে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ছুটি নেন। সর্বশেষ, তিনি বিদেশ থেকেই পদত্যাগ করেন,” বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের এই মন্তব্যের সাথে দ্বিমত করে বিচারপতি সিনহা বেনারকে জানান, বিচারপতিরা তখন তাঁর সাথে দেখা করে তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রপতি তাঁদেরকে তাঁর সাথে কাজ করতে বারণ করেছেন।

“তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি বলেছেন আপনার বিরুদ্ধে অনেকগুলো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তিনি (রাষ্ট্রপতি) আপনার সাথে কাজ করতে আমাদের বারণ করেছেন।’ ফলে তাঁরা আমার সাথে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে আমাকে জানিয়েছেন তাঁরা।”

তিনি বলেন, “আমি যদি দুর্নীতিগ্রস্তই হতাম, তাহলে সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে আমাকে পদ থেকে অপসারণ না করে, তাঁরা আমাকে জোর করে তাড়াল কেন?

সরকার তাঁর সাথে যে আচরণ করেছে তাতে এখনো তাঁর ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়,” বলে জানান সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।