সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিচার শুরু

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.08.13
ঢাকা
200813_Sinha_Trial_Begins_620.JPG দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া রওয়ানা দেবার আগ মুহূর্তে নিজের সরকারি বাসভবনের গেটে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ১৩ অক্টোবর ২০১৭।
[বেনারনিউজ]

চার বছর আগে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাত ও সেই অর্থ পাচার মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি ‍সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এসকে সিনহা) আরও ১০ ব্যক্তির বিচার শুরু হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই বিচার শুরু হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান এ মামলায় দুদকের অন্যতম আইনজীবী রুহুল ইসলাম খান।

তিনি জানান, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ ১৮ আগস্ট শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বিচারক শেখ নাজমুল আলম।

এই মামলায় এসকে সিনহাসহ মোট আট আসামি পলাতক রয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। এসকে সিনহা বর্তমানে কানাডা অবস্থান করছেন।

বাংলাদেশের ২২ জন প্রধান বিচারপতির মধ্যে ২১মত প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাই প্রথম যার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর বিচার শুরু হলো।

এই মামলার অন্য ১০ আসামির মধ্যে ছয়জন সাবেক ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) এর পদস্থ কর্মকর্তা।

ব্যাংকটির অভিযুক্ত সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীম ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন জামিনে রয়েছেন। নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীকে ওরফে বাবুল চিশতী রয়েছেন কারাগারে।

বাকিরা সবাই পলাতক। তাঁরা হলেন- ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, গুলশান শাখার ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সফিউদ্দিন আসকারী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক (পলাতক)।

অন্যান্যরা হলেন এসকে সিনহার পিএস হিসাবে পরিচিত রণজিৎ চন্দ্র সাহা, রণজিতের স্ত্রী সান্ত্রী রায় (সিমি), টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা। তাঁরাও সবাই পলাতক।

বিচার প্রক্রিয়া শুরুর সময় একেএম শামীম, গাজী সালাহউদ্দিন ও বাবুল চিশতি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন বলে জানান আইনজীবী রুহুল ইসলাম খান।

একেএম শামীম ও গাজী সালাহউদ্দিন এর আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম বেনারকে বলেন, “ঋণ দেয়ায় কোনো অনিয়ম হয়নি। কারণ ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী কতদিনে মধ্যে ঋণ দিতে হবে তার কোনো সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া নাই। আর যে পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসাবে দেয়া আছে তার চেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি জামানত হিসাবে ব্যাংকের কাছে রাখা আছে।”

তাই, তিনি তাঁর মক্কেলদের মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন জানান।

শুনানি শেষে বিচারক পলাতক আটজনসহ ১১ আসামির সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর সিদ্ধান্ত দেন।

কী অভিযোগ?

দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ফারমার্স ব্যাংক গুলশান শাখায় দুটি চলতি হিসাব খোলেন।

পরদিন ৭ নভেম্বর ওই দুইজন ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। হিসাব খোলা এবং ঋণের আবেদনে তাঁরা ঢাকার উত্তরার যে বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করেন সেই বাড়িটির মালিক এসকে সিনহা।

ওই ঋণ আবেদনটি খুব দ্রুত গতিতে কোনো প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই গুলশান শাখার কর্মকর্তারা অনুমোদন করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। প্রধান কার্যালয়ের ওই সকল কর্মকর্তারা কোনো প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই ঋণ অনুমোদন দিয়ে দেন। ব্যাংকের নোটে বলা হয় এই ঋণ আবেদনে প্রধান বিচারপতির সমর্থন আছে।

পরদিন ৮ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে চার কোটি টাকা এসকে সিনহার নামে ইস্যু করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ওই পে-অর্ডার দুটি সোনালী ব্যাংক সুপ্রিমকোর্ট শাখায় এসকে সিনহার ব্যক্তিগত হিসাবে জমা হয়। তিনি বিভিন্ন সময় ক্যাশ ও চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিতে দিয়ে ওই টাকা উত্তোলন করেন।

ওই টাকার মধ্যে শাহজালাল ব্যাংকে তাঁর ভাইয়ের হিসাবে প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা পার করা হয়। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এই কাজ মানি লন্ডারিং হিসাবে বিবেচিত।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন সাহা অত্যন্ত দরিদ্র এবং তাঁদের কোনো ব্যবসা ছিল না। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা তাঁদের ব্যবহার করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

বিরোধীদল বলছে ভিন্ন কথা

বিএনপির সমর্থিত আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা মনে করি এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসাবে বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সরকারের আক্রোশে ছিলেন। সরকারের সব কথা শোনেননি। সে কারণে তাঁর দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে।”

তিনি বলেন, “তিনি বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধন বিলটি বাতিল করে দেয়ার কারণে সরকারের রোষানলে পড়েন। সরকারের কথা শুনলে তাঁর কিছু হতো না।”

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “এসব একদম বাজে কথা। বর্তমান সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন কিছু বর্তমান সরকার করেনি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকলে উনি কীভাবে সংসদে পাশ করা আইন বাতিল করে দিলেন?”

তিনি বলেন, “সিনহা সাহেব দুর্নীতি করেছেন। সেকারণে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সরকার তো মামলা করেনি। বিচার শুরু হয়েছে। বিচার তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।”

মামলার বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বর্তমানে কানাডায় অবস্থানরত এসকে সিনহার সাথে বেনারের পক্ষ থেকে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে গত বছরের জুলাইতে মামলা দায়েরের পর তিনি বেনারকে জানিয়েছিলেন, তাঁকে ‘জনসম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন’ করার উদ্দেশ্যেই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।

দেশে ফিরে তাঁর এই মামলা মোকাবেলা করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলেও তখন জানিয়েছিলেন তিনি।

সংবিধান সংশোধন বিল

১৯৭২ সালের মূল সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনে ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন।

তিনি সংবিধান থেকে ওই ধারা তুলে দিয়ে বিচারকদের অভিশংসনে ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে অর্পন করেন। এটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল হিসাবে পরিচিত।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাশের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। ওই বিলকে চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন এক আইনজীবী।

২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার।

২০১৭ সালের ৩ জুলাই আপিলটি খারিজ করে দেয় এসকে সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট। এই রায়ের পর সরকারের অনেকে তাঁর সমালোচনা করেন।

মিডিয়ায় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অসুস্থতার খবর প্রকাশ পায়।

২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর তিনি ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান। যাওয়ার আগে তিনি জানান, তিনি অসুস্থ নন। তিনি সরকারের চাপে বিদেশ যাচ্ছেন। আবার দেশে ফিরবেন।

পরদিন সুপ্রিম কোর্ট এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, এসকে সিনহার বিরুদ্ধে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ আসে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে। রাষ্ট্রপতি সেগুলো আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারকের কাছে হস্তান্তর করেন।

বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয়, বিষয়টি এসকে সিনহার কাছে উত্থাপন করে তাঁর জবাব চাওয়া হলেও তিনি কোনো জবাব দিতে পারেননি। সে কারণে তাঁর সাথে কোনো বিচারক বিচার কার্য চালাবেন না বলে জানিয়েছেন।

১১ নভেম্বর বিদেশ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান এসকে সিনহা।

প্রধান বিচারপতি হিসাবে ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেন দেশের ইতিহাসে প্রথম হিন্দু ধর্মাবলম্বী এসকে সিনহা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।