সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুমোদন

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.12.04
ঢাকা
191204_Charges_Sinha-Bangla_1000.jpg দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া রওয়ানা দেবার আগ মুহূর্তে নিজের সরকারি বাসভবনের গেটে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ১৩ অক্টোবর ২০১৭।
[বেনারনিউজ]

দেশত্যাগী সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে।

বুধবার কমিশন সেই অভিযোগটি অনুমোদন দিয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান। মামলায় এসকে সিনহা ছাড়াও আরও ১০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো বর্তমান অথবা সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হলো বলে জানান বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।

তবে সিনহার বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার মিথ্যা অভিযোগ আনায় সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে দুদক মামলা করবে বলে জানান মহাপরিচালক সাঈদ।

দুদকের এই অভিযোগ অনুমোদনের পর এখন মামলার বিচার শুরুর উদ্যোগ নিতে অচিরেই অভিযোগপত্রটি বিচারিক আদালতে দাখিল করা হবে বলে বেনারকে জানান দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।

কী বলছে দুদক

মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান বলেন, “এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুজন সাধারণ ব্যক্তির নামে চার কোটি টাকার ভুয়া লোন সৃষ্টি করে নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়ে আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা হয়েছিল।”

তিনি বলেন,“এই মামলাতে এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল। এটি কমিশন অনুমোদন দিয়েছে।”

প্রসঙ্গত চলতি বছরের ১০ জুলাই বিচারপতি এসকে সিনহাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে এই মামলাটি দায়ের করেছিল দুদক।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বেনারকে বলেন, “সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে ফারমার্স ব্যাংকের অর্থ আত্নসাৎ ও ঋণ জালিয়াতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। আজ সেই অভিযোগটি অনুমোদন দিয়েছে দুদক।”

তিনি বলেন, “পরবর্তী ধাপ হলো, দুদক অভিযোগপত্রটি বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে দেবে। আদালত অভিযোগটি আমলে নেবে কি না সেব্যাপারে শুনানি হবে। এরপর আমলে নিলে সিনহার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জ গঠিত হবে। এবং বিচার শুরু হবে।”

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক বিএনপি নেতা নাজমুল হুদার আনীত অভিযোগ সম্পর্কে খুরশিদ আলম খান বলেন, “উনি এ বছর সেপ্টেম্বরে শাহবাগ থানায় এসকে সিনহার বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকার বেশি ঘুষ নেয়ার অভিযোগ মামলা করেন।”

“কিন্তু দুদক তদন্ত করে দেখেছে সেই অভিযোগগুলো সঠিক নয়। তাই, দুদককে মিথ্যা তথ্য প্রদানের দায়ে নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে নাজমুল হুদার দুই বছরের সাজা হতে পারে,” জানান খুরশিদ আলম খান।

সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য এসকে সিনহা বাংলাদেশে ২১তম প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দিয়ে পাশ করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেয়। বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এসকে সিনহার।

সেই জেরে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথমে ছুটি নিয়ে বিদেশ যান তিনি। পরে সেখান থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বেনারকে বলেন, “সাবেক বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে সরকারের রাজনৈতিক মটিভ আছে।”

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন। এখানে সরকারের কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই।

অন্যান্য আসামি

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জ এনেছে দুদক। তিনি ছাড়াও অন্যান্য আসামিরা হলেন; প্রাক্তন ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীম, একই ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সফিউদ্দিন আসকারী আহমেদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, মো. শাহজাহান, নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, সান্ত্রী রায় (সিমি), রনজিৎ চন্দ্র সাহা এবং ফার্রমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী)।

এজাহারে উল্লেখ থাকা আসামি মো. জিয়া উদ্দিন আহমেদ তদন্তকালে মৃত্যুবরণ করায় তাঁকে অত্র মামলার দায় হতে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।

দুদকের অভিযোগ

আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় দুইটি আলাদা হিসাব খোলেন।

নিজেদের ব্যবসায়ী হিসাবে চিহ্নিত করে পরদিন তাঁরা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন।

নিয়মবহির্ভূতভাবে অনুমোদন পাওয়া সেই অর্থ দ্রুত এসকে সিনহার সোনালী ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।

পরে সেই অর্থ পাচার করা হয়েছে অথবা পাচারের সংঘবদ্ধ চেষ্টা হয়েছে।

শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্রর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং ঋণের আবেদনে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, সেই বাড়ির মালিক ছিলেন এসকে সিনহা।

ওই ঋণের আবেদনে জামানত হিসেবে আসামি রণজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয়।

আর এই কাজ করে তারা দণ্ডবিধি, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বেনারকে বলেন, “প্রথম কথা হলো, দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে চার্জ গঠন করেছে। এ ব্যাপারে কারও কিছু বলা উচিত নয়। আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত।”

তিনি বলেন, “তিনি অপরাধী কি না সেব্যাপারে রায় দেবেন আদালত। তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। কারণ, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান।”

খায়রুল হক বলেন, “উনি দেশে নেই। তবে উনি যদি মনে করেন কোনো অপরাধ করেননি তাহলে তাঁর উচিত দেশে এসে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা।”

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বর্তমানে কানাডায় অবস্থানরত এসকে সিনহার সাথে বেনারের পক্ষ থেকে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে গত জুলাইতে মামলা দায়েরের পর তিনি বেনারকে জানিয়েছিলেন, তাঁকে ‘জনসম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন’ করার উদ্দেশ্যেই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।

দেশে ফিরে তাঁর এই মামলা মোকাবেলা করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলেও তখন জানিয়েছিলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।