এক বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত ৪৬৬: আসক

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.01.10
ঢাকা
190110_ASOK_1000.JPG ঢাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত কামরুলের মৃতদেহের ছবি মোবাইল ফোনে দেখাচ্ছেন তাঁর এক আত্মীয়। ২৬ মে ২০১৮।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও গত বছর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ‘চরম উদ্বেগজনক’ উল্লেখ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)। গুম-অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনায় দেশের মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানিয়েছে তারা।

বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আসকের এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়।

গত এক বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার ওপর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আসকের উপপরিচালক নীনা গোস্বামী ও জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির।

আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিগত বছরগুলোর মতো ২০১৮ সালের সার্বিক মানবাধিকার-পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। বছরজুড়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে ক্রস-ফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময় এবং গুম-গুপ্তহত্যার ঘটনা অব্যাহত ছিল।”

প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছরের মে মাস থেকে শুরু হওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে সারাদেশে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ২৯২ জনের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

তবে সরকারি বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করে এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

তিনি বেনারকে বলেন, “সরকার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। এসব মাদক কারবারি সব সময় অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করে। বাধা দিলেই তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর গুলি চালায়।”

মন্ত্রী বলেন, “যারা পুলিশ-র‍্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে, আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের বিচার করা হয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলি চালালে তারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালাবেই। সুতরাং, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সত্য নয়।”

আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আমরা কাউকে বিনা বিচারে বা নিরাপদ হেফাজতে হত্যা করিনি। কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যাদের আটক করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা এই প্রতিবেদনের সাথে একমত নই।”

৪৬৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যা

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে প্রস্তুত তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, “২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময়, এনকাউন্টার এবং হেফাজত’ মোট ৪৬৬ জন নিহত হন।”

আসক বলছে, নিহতদের মধ্যে ৪ মে থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছেন ২৯২ জন।

আসকের তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময়, এনকাউন্টার এবং হেফাজতে নিহত হয়েছিলেন মোট ১৬২ জন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কারণ, আমাদের বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার করা যাচ্ছে না। আদালত থেকে তারা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “ফলে সাধারণ মানুষ এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন। এজন্য যারা এসব কাজ করেন তাঁরা উৎসাহিত হচ্ছেন।”

ড. মিজানুর রহমান বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই নিরপরাধ মানুষ এর শিকার হচ্ছেন। আবার অনেক সময় ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য অনেককে অপরাধী বানিয়ে হত্যা করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “নতুন সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী মানবাধিকার সুসংহত করবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। তাই আমরা আশা রাখি দেশে ভবিষ্যতে সকল প্রকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে।”

গণগ্রেপ্তার ও গায়েবি মামলা

আসক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালের আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, বেআইনি আটক ও গণগ্রেপ্তারসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর মতো ঘটনা।

এ বছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত গায়েবি মামলার বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোর মতে, গত বছর শুধু সেপ্টেম্বরেই ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় পুলিশ বাদী হয়ে ৫৭৮টি নাশকতার মামলা দায়ের করে।

এসব মামলার তথ্য অনুযায়ী, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯০বার। অথচ বাস্তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি বলে উক্ত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা সহিংসতায় অনেক মানুষের হতাহতের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

বিরোধী রাজনৈতিক দল বা জোটের প্রার্থী ও তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর আক্রমণ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেওয়া এবং নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আসকের মতে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও উদ্বেগজনক ছিল ২০১৮ সাল।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েকটি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা সংঘটিত হয় এবং পাশাপাশি বছরের বিভিন্ন সময়ে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

আসক জানায়, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

বাধাগ্রস্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা

আসক এর প্রতিবেদন মতে, মতপ্রকাশের অধিকারের ক্ষেত্রেও চলতি বছরের চিত্র ছিল হতাশাজনক।

সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের ব্যাপক সমালোচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদে পাশ হয় বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮।

এ আইনটির ফলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন- ২০০৬-এর বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল হলেও মত প্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করার মতো কয়েকটি ধারা নতুন আইনে সন্নিবেশিত হয়েছে। এ ছাড়া সভা-সমাবেশের অধিকারকেও বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে বছরের বিভিন্ন সময়।

২০১৮ সালের এপ্রিল-মে জুড়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে এবং আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের হামলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বলপ্রয়োগসহ আটক-নির্যাতন ও মামলার ঘটনা ঘটে।

এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা ও মারধরের ঘটনা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।

এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে আটকের ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে।

গুম, অপহরণ মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটেই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গুম-অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনায় মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হচ্ছে।

দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে গুম, অপহরণ, নিখোঁজ ও গুপ্তহত্যার বিষয়ে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে জানা যায়, ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ৩৪ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ১৯ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন মামলায় আটক আছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।