দুর্বৃত্তের আগুনে পুড়ে ছাই বাউলের চল্লিশ বছরের সংগ্রহ

জেসমিন পাপড়ি
2020.05.19
ঢাকা
200519_Baul_story_620.jpeg সুনামগঞ্জ দিরাইয়ের উজানধল গ্রামে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া গান ঘরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বাউল রণেশ ঠাকুর। ১৯ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে সুনামগ‌ঞ্জে এক ব‌াউলের গানের ঘর ও বাদ্যযন্ত্র পুড়ে যাওয়ার দুইদিন পরও ওই ঘটনায় কেউ আটক হয়নি। অভিমানে ক্ষতিগ্রস্ত ওই বাউল মামলা করেননি।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের ওই বাউলের নাম র‌ণেশ ঠাকু‌র, বয়স ৫৫। সোমবার ভোর রাতে তাঁর বসতবাড়ি সংলগ্ন গা‌নের ঘরে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই আগুনে গানের বই, খাতা ও বাদ্যযন্ত্রসহ আসবাব পুড়ে যায়।

রণেশ বেনারকে বলেন, “আমার ধারণা, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই আগুন দিয়েছে। তবে কারা দিয়েছে তা জানি না। ঘরটিতে আমার ৪০ বছরের সব সাধনা জড়ো করা ছিল, নিমিষেই ছাই হয়ে গেল।”

দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম নজরুল ইসলাম বেনারকে জানান, “রোববার রাত দেড়টার দিকে উজানধল গ্রামে রণেশের বাড়িতে থাকা গানের ঘরটিতে আগুন লাগে। আগু‌নে বাউলের দোতারা, বেহালা, হারমো‌নিয়ামসহ গান গাওয়ার সব যন্ত্রপা‌তি পু‌ড়ে গে‌ছে।”

প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

নজরুল ইসলাম বলেন, “এ বিষয়ে রণেশ বাউল মামলা করেননি। তিনি মামলা করলে বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখব।”

রণেশ বলেন, “পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মামলা করে কী হবে? আমি কি পুড়ে যাওয়া সব স্বপ্ন ও সাধের জিনিসগুলো ফেরত পাব? তারপরেও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেব, মামলা করব কি না।”

বাউল নেতারা বলছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির দ্বারাই বারবার বাউলেরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।

বাউল নেতা কাজল দেওয়ান বেনারকে বলেন, “দেশে বাউলদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ তো অসাম্প্রদায়িক। কোথা থেকে এই সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের।”

“অথচ সরকার এ বিষয়ে উদাসীন। সরকার একটু সচেতন হলেই বাউল শিল্পীরা এ ধরনের হামলার শিকার হতো না। মিথ্যা মামলায় জেলে যেত না,” বলেন তিনি।

উল্লেখ্য, এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একজন বাউলকে আটক করা হয়।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এক অনুষ্ঠানে গানের আগে দেয়া বক্তব্যে শরিয়ত সরকার নামের এই বয়াতি ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করেছেন—এমন অভিযোগে এলাকায় বিক্ষোভ হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

বর্তমানে শরিয়ত সরকার জেলে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন কাজল দেওয়ান।

চল্লিশ বছরের সাধনা পুড়ে ছাই

রণেশ ঠাকুর জানান, তাঁর বসত ঘরের উল্টোদিকে বাউল গা‌নের ঘর। সেখানে শিষ্যদের নিয়ে গানের আসর করতেন তিনি। এই ঘরটিতেই তাঁর ও শিষ্যদের সব বাদ্যযন্ত্র রাখা হতো।

রণেশ জানান, সোমবার ভোর হওয়ার কিছু আগে তাঁর বড় ভাইয়ের স্ত্রীর চিৎকারে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখেন গা‌নের ঘর পুড়ে যাচ্ছে। আশপাশের লোকজন চেষ্টা করে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়, তবে ততক্ষণে পুরো ঘর ও সেখানে রাখা সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

র‌ণেশ ঠাকুর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল ক‌রি‌মের শিষ্য। প্রয়াত করিমের বাড়ির পাশেই রণেশের বাড়ি।

রণেশ বলেন, “আমি ও আমার বড় ভাই শাহ করিমের শিষ্য। আমি নিজেও প্রায় দুই হাজার গান লিখেছি। সেসব গানের ডায়রিও আগুনের পুড়ে গেছে। সব গান তো আর মনে নেই। জানি না স্মৃতি থেকে আদৌ সেসব আর লেখা সম্ভব কি না।”

“তা ছাড়া ৫০ থেকে ১০০ বছরের বহু পুরাতন গানের বই আমি বছরের পর বছর ধরে সংগ্রহ করেছিলাম, সেসবও আর রইল না,” বলেন তিনি।

কারা আগুন লাগিয়েছে জানতে চাইলে বাউল রণেশ বলেন, “শিষ্যদের নিয়ে আমরা এখানে গান বাজনা করি। যারা এসব পছন্দ করে না, তারাই ইচ্ছে করেই আগুনটা লাগিয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমি মাটি ও মানুষের গান গাই। তবু কেন ক্ষতি করল বুঝতে পারছি না। আমার গান নিয়ে কখনো কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি।”

দিরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শফিউল্লাহ জানান, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার সকালে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় পুড়ে যাওয়া ঘরটি মেরামত করার জন্য রণেশকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

ইউএনও জানান, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে ঘরে ছাউনি দিতে টিন সরবরাহ করা হবে।

শফিউল্লাহ আরও বলেন, “ঘরটিতে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে এমন কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।