পাহাড়ে সহিংসতা: খাবার আয়োজনের মধ্যে গুলি, নিহত ছয়

পুলক ঘটক
2020.07.07
ঢাকা
200707_Bandarban-620.jpg বান্দরবানের বাঘমারা বাজার পাড়ায় অজ্ঞাত পরিচয় দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করার পর ঘটনাস্থলে একটি মরদেহ তদন্ত করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ৭ জুলাই ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বান্দরবান সদর উপজেলার বাঘমারা বাজার পাড়ায় বাড়িতে ঢুকে গুলি চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-এমএন লারমা) সংস্কারপন্থী অংশের নেতৃস্থানীয় ছয়জনকে হত্যা করেছে অজ্ঞাত পরিচয়ের দুর্বৃত্তরা।

“মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে বান্দরবান শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বাঘমারায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে,” বেনারকে জানান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল আলম চৌধুরী।

“জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থী অংশের বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতির বাড়িতে একটি গ্রুপ হামলা চালায়। তারা এলোপাতাড়ি গুলি করেছে। সভাপতি রতন সেনসহ ছয়জন ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। আহত আরও তিনজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে বান্দরবান সদর হাসপাতাল, পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে,” বলেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শী এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থী অংশের বান্দরবান জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমা টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “বাঘমারা বাজারে আমাদের অফিসে একটা মিটিং ছিল। খাওয়ার আয়োজন ছিল সভাপতির বাড়িতে। সকালে আমরা কয়েকজন খাওয়ার জন্য ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম।”

“বাড়ির বাইরে সবার খাওয়ার জন্য তখন রান্না করা হচ্ছিল। ভোর ছয়টার দিকে হঠাৎ করে কয়েকজন লোক সেখানে এসে এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। আমি বাড়ির ভেতরে ছিলাম। আমি শুয়ে পড়ায় বেঁচে গেছি,” বলেন তিনি।

উবামং মারমা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য জনসংহতি সমিতির প্রতিপক্ষ গ্রুপটিকে দায়ী করেছেন।

সংস্কারপন্থী অংশের সদস্য এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াই মং মারমা বেনারকে বলেন, “আমি বাড়ির ভেতরে ছিলাম। রতন সেন সকালের দিকে বাইরের উঠানে সবার জন্য ভাত রান্না করছিলেন। তাঁকেসহ অন্যদের গুলি করে মারা হলো।”

তিনি বলেন, “আক্রমণকারী ৮-৯ জন হবে। তবে বাড়িতে ঢুকেছিল দুইজন। বাকিরা বাইরে ছিল।”

নিহতরা হলেন; জনসংহতি সমিতি সংস্কারপন্থী গ্রুপের বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যা (৬৫), সাধারণ সম্পাদক প্রজিত চাকমা (৬২), ডেভিড মারমা (৫৫), জয় ত্রিপুরা (৪০), দীপেন ত্রিপুরা (৪২) ও মিলন চাকমা (৬০)।

গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় মেডিকেলে আছেন জেএসএস-এমএন লারমা দলের সদস্য খাগড়াছড়ির রামগড়ের বিদ্যুৎ চাকমা (৪০), রাজবিলা ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য শৈএনু মারমার মেয়ে হ্লাওয়াং সিং মারমা (২৫) এবং দীঘিনালার বাসিন্দা নিরু চাকমা (৫০)।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার জেরিন আক্তার বেনারকে বলেছেন, “দুই পক্ষের গোলাগুলির খবর পেয়ে পুলিশ সদস্যরা সেখানে ছুটে যায়। সেখানে মোট ছয়জনের লাশ পাওয়া গেছে। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে।”

“ঘটনার পর বাঘমারা বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। আতঙ্কে স্থানীয়রা অনেকেই নিরাপদ জায়গায় চলে গেছেন। থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে বাঘমারা ও আশপাশের এলাকায়,” বেনারকে বলেছেন বাঘমারা এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের কাউন্সিলর সামপ্রুই মারমা।

গত মার্চ মাসে রতন তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি করে বান্দরবানে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থী গ্রুপের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর থেকেই জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমা গ্রুপের সঙ্গে তাঁদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল।

বান্দরবান সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিদ্যুৎ চাকমা স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাঁরা খাগড়াছড়ি থেকে মে মাসে বান্দরবানে এসে প্রথমে বাঘমারা বাজারপাড়ায় দলীয় সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে বাঘমারা বাজারের একটি দোতলা ভবনে অফিস নিয়ে ২৫-৩০ জন থাকেন।

সেখান থেকে সকাল, দুপুর ও বিকেলে বাজারপাড়ায় গিয়ে রান্নাবান্না করে খাওয়া-দাওয়া করেন। সকালে তিনি যখন রান্না করছিলেন, তখন তাঁদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করা হয়েছে। এতে তাঁর ডান বাহুতে গুলি লেগেছে।

একইভাবে নিহার চাকমাও ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের প্রতিরক্ষা দলটি রাজেন্দ্রপাড়ায় অবস্থানের সুযোগে জেএসএস মূল দলের অস্ত্রধারীরা হামলা করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

পাহাড়ে সহিংসতা থামছে না

১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তি পরিষদের সঙ্গে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পর গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিগত দুই দশকে দেড় হাজারের বেশি মানুষ সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। নিয়মিত বিরতিতে পাহাড়ে সহিংস ও রক্তাক্ত ঘটনা ঘটছে।

আদিবাসীদের মতে, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াই এর প্রধান কারণ।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং বেনারকে বলেন, “চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার হতাশা থেকে অনেকগুলো গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এসব গ্রুপকে কারা অস্ত্র দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।”

“পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ হয়েছে নামে মাত্র। পরিষদের কথা পুলিশ, প্রশাসন কেউ শোনে না। তবে ঘটনা যারাই ঘটাক, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার জন্য স্বাভাবিক নিয়মেই সরকারের ওপর দায় বর্তায়,” বলেন তিনি।

মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “গত ১০ বছরে যত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার একটিরও কি বিচার হয়েছে? কারা মুখোশ পরে হামলা চালায়, তাদের কেন শনাক্ত করা যাচ্ছে না? অতি দামী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সেখানে কোথা থেকে কীভাবে আসেছে—এসবের তদন্ত হওয়া দরকার।”

১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে সন্তু লারমার পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ছেড়ে ইউপিডিএফ গঠন করেছিলেন প্রসীত খিসা।

প্রায় এক যুগ আগে জনসংহতি সমিতি আরেক দফা ভেঙে সুধা সিন্দু খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএসএস (এমএন লারমা)। সেই অংশটিই স্থানীয়ভাবে জেএসএস এর সংস্কারপন্থী অংশ হিসেবে পরিচিত।

আবার তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার নেতৃত্বে ইউপিডিএফের সংস্কারবাদী একটি অংশ তিন বছর আগে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন দল গঠন করে। এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে জেএসএস এর এমএন লারমা অংশের সঙ্গে তাদের এক ধরনের মিত্রতা তৈরি হয়।

পাহাড়ি সংগঠনগুলোর এই বিভক্তির পথ ধরে ২০১৮ সালে পার্বত্য জেলাগুলোতে নতুন করে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়।

ওই বছর ৩ মে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থী অংশের সহসভাপতি শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন তাঁর শেষকৃত্যে যাওয়ার পথে হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফের সংস্কারপন্থী অংশের নেতা তপনজ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।