সপ্তাহ না ঘুরতেই পাহাড়ে আবার রক্ত

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.08.23
ঢাকা
180823_Tribal_story_620.JPG বান্দরবানের আলীকদম বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে কলা ও শাক নিয়ে মাতামুহুরি নদীর পাড়ে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছেন ম্রো সম্প্রদায়ের দুই যুবক। ১৩ এপ্রিল ২০১৮।
কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ

সপ্তাহ পার না হতেই আবার রক্ত ঝরল পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়। গত ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়িতে সাতজনকে হত্যার পর বুধবার রাতে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন মিশর চাকমা (৩২) নামে এক যুবক।

পুলিশ বলছে, নিহত মিশর জন সংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) গ্রুপের তথ্য আদানপ্রদানকারী বা ইনফরমার ছিলেন। তাঁকে প্রতিশোধমূলক কারণে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।

জেএসএস-এমএন লারমা গ্রুপের নেতারা মিশর হত্যার জন্য প্রতিপক্ষ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) দায়ী করেছেন।

তবে ইউপিডিএফ মিশরকে তাদের সমর্থক বলে দাবী করে হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

রাঙ্গামাটি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেন বেনারকে বলেন, মিশর চাকমাকে বুধবার রাতে তাঁর বাঘাইছড়ির বাসায় পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।

তিনি বলেন, “আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে নিহত মিশর জন সংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপের একজন তথ্য আদানপ্রদানকারী অর্থাৎ ইনফরমার। তাঁদের প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ তাঁকে হত্যা করে থাকতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।”

তিনি বলেন, “বাঘাইছড়ি জেলা সদর থেকে পাঁচ ঘন্টার হাঁটা পথ। আমরা লাশ নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।”

জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এখানে মারামারি ও হত্যাকাণ্ড খুবই স্বাভাবিক ও সাধারণ ব্যাপার। যে কোনো মুহূর্তে আবার নিজেরা মারামারি শুরু করতে পারে।

তিনি বলেন, “কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটলে আগে উপজাতিরা পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করত না। এখন তারা মামলা দায়ের করে। নিহত মিশর চাকমার পরিবারের সদস্যরা এখনো মামলা করেনি।”

জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “যদি পরিবারের সদস্যরা মামলা না করে সেক্ষেত্রে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করবে।”

জেএসএস (এমএনলারমা) বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি সুরেশ কান্তি চাকমা নিহতকে তাঁদের কর্মী দাবি করে সাংবাদিকদের বলেন, ইউপিডিএফের উদয় বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে মিশর চাকমাকে হত্যা করা হয়।

তিনি বলেন, “মিশরকে তার বাসায় ঢুকে প্রথমে লাঠি দিয়ে ব্যাপকভাবে আঘাত করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তারা গুলি করে পালিয়ে যায়।”

তবে ইউপিডিএফ মুখপাত্র মাইকেল চাকমা বেনারকে বলেন, “নিহত মিশর চাকমা আমাদের যুব সংগঠনের সদস্য ছিল। আমরা তাকে মারব কেন?”

তিনি বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য, ভিত্তিহীন।”

এর আগে গত ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ি শহরে ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতিসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। সেদিন শহরের স্বনির্ভর এলাকায় অতর্কিত এ হামলার ঘটনা ঘটে।

সেদিনের হত্যাকাণ্ডে নিহতরা হলেন ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি তপন চাকমা, সহ-সাধারণ সম্পাদক এল্টন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের জেলা সহ-সভাপতি পলাশ চাকমা এবং তিন পথচারী উত্তর খবংপয্যা গ্রামের বাসিন্দা ও জেলার মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী জিতায়ন চাকমা (৫৩), একই গ্রামের কান্দারা চাকমার ছেলে রুপম চাকমা ও ধীরাজ চাকমা।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ি শহরের পেরাছড়ায় একটি মিছিল বের করা হলে সেখানেও হামলা চালায় আক্রমণকারীরা। হামলায় আরেকজন নিহত হন।

এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করেছেন প্রসীত বিকাশের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের মূখপাত্র মাইকেল চাকমা।

তবে জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) শনিবারের হত্যাকাণ্ডের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে। তারা বলেছে, শনিবারের হত্যাকাণ্ড ইউপিডিএফ এর দ্বন্দ্বের কারণেই।

কেন এই হত্যাকান্ড?

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর ও আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)।

ওই চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৭ সালেই পিসিজেএসএস এর আরেকটি গ্রুপ ইউপিডিএফ গঠন করে।

এর ১০ বছর পর ২০০৭ সালে আরেক গ্রুপ জন সংহতি সমিতি-মানবেন্দ্র লারমা গ্রুপ গঠন করে।

আরো ১০ বছর পর ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক গঠিত হয়।

বিবদমান গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বেনারকে বলেন, “দেখুন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ভেঙে বর্তমানে চারটি দল হয়েছে। এরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাতে লিপ্ত। এর মধ্যে অর্থনীতিও একটি বড় ব্যাপার।”

তিনি বলেন, “এই হানাহানি ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে।”

গৌতম বলেন, “১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে পাহাড়িরা বিশ্বাস করে। সেকারণেই দলগুলো নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে দল, উপদল।”

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি সীমান্ত এলাকা। এখানে বিভিন্ন অপরাধী চক্র থাকে যারা তাদের স্বার্থে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে।

তাঁর মতে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হলে এখানকার সংঘর্ষ বন্ধ হয়ে যাবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।