থানায় নির্যাতনে যুবকের মৃত্যু: তিন পুলিশের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.09.09
ঢাকা
200909_Police_Punished-1000.jpg থানায় নির্যাতন করে এক যুবককে হত্যার দায়ে মামলার রায়ের পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই জাহিদুর রহমান খানকে ঢাকার আদালত থেকে বের করে নিয়ে আসছে পুলিশ। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের প্রায় সাত বছরের মাথায় ঘোষিত প্রথম মামলার রায়ে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। থানার ভেতর একজন গাড়িচালককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশ বুধবার রায় ঘোষণা করে বলেন, ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন পাশের পর এই আইনে করা মামলার এটিই প্রথম রায়। তিন পুলিশ সদস্যকে এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

একই ঘটনায় পুলিশের দুই সোর্সকে সাত বছর করে কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

আ​ইনটি হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবী থানায় ইশতিয়াক হোসেন জনি (২৯) নামের ওই গাড়ি চালককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনজীবী মশিউর রহমান বেনারকে জানান, ওই ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত তিন পুলিশ কর্মকর্তা হলেন; পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই জাহিদুর রহমান খান, এএসআই রাশেদুল ইসলাম ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু।

ব্লাস্ট মামলার বাদী ও নিহতের ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে আইনগত সহয়তা প্রদান করেছে। রায় ঘোষণার পর এক বিবৃতি​তে ব্লাস্ট সন্তোষ প্রকাশ করেছে​।

“যাবজ্জীবন সাজার পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দিতে হবে তাঁদের। অনাদায়ে আরও ছয় মাস জেল খাটতে হবে। এই অর্থদণ্ড ছাড়াও নিহতের পরিবারকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সাজাপ্রাপ্ত প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে,” জানান মশিউর রহমান।

ওই আইনজীবী জানান, ক্ষতিপূরণের এই টাকা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিবারকে দিতে হবে এবং ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে কোনো আপিল চলবে না বলে জানিয়েছে আদালত।

এই মামলায় সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে পুলিশের দুই সোর্স সুমন ও রাসেলকে, তাঁদের দুইজনকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “ভিকটিমের তিনজন বন্ধু এ মামলার চাক্ষুষ সাক্ষী। তাঁরা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, নির্যাতনের সময় ভিকটিম পানি চাইলে তাঁর মুখে থুথু ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কেবল আইনের বরখেলাপ নয়, মানবাধিকারের চরম লংঘন।”

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা রায়ে সন্তষ্ট নন। বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তাঁরা।

পাঁচ আসামির মধ্যে পল্লবী থানার তখনকার এসআই জাহিদুর রহমান খান ও পুলিশের সোর্স সুমন কারাগারে আছেন। জামিনে থাকা এএসআই রাশেদুলকে রায়ের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

বাকি দুই আসামি এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু এবং পুলিশের সোর্স রাসেল জামিন পেয়ে পলাতক রয়েছেন। ওই দুইজনকে পলাতক ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়েছে।

কী ঘটেছিল?

নিহত জনির ছোট ভাই ও মামলার বাদী ইমতিয়াজ হোসেন রকি বেনারকে জানান, ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত অর্থাৎ ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরে পল্লবীতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে পুলিশের সোর্স সুমন মাতাল অবস্থায় এসে পাঞ্জাবি খুলে নোংরা আচরণ করতে থাকেন।

তিনি জানান, সুমনকে প্রথমে এহেন আচরণ করতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সুমন কথা না শুনে আবার একই আচরণ করতে থাকেন।

রকি জানান, “তখন আমার ভাই জনি সোর্স সুমনকে থাপ্পড় মেরে অনুষ্ঠান থেকে বের করে দেয়। যাওয়ার সময় সোর্স সুমন আমাদের বলে যায় সে দেখে নেবে।”

“এই ঘটনার ৩০ মিনিটের মধ্যে এসআই জাহিদসহ অনেক পুলিশ এসে বিয়ের অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাংচুর করে। তারা আমার ভাই এবং আমাকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। সেখানকার মানুষ একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানালে পুলিশ সদস্যরা ফাঁকা গুলি করে,” বলে রকি।

রকি জানান, “সেখান থেকে আমাদের পল্লবী থানার দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় আরও পাঁচজনকে আটক করে। থানায় নিয়ে আমার ভাই এবং আমার দুই হাতে হাতকড়া পরানো হয়। এরপর পিলারের সাথে আটকে রেখে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আমাদের পেটায় ছয়-সাত জন পুলিশ সদস্য।”

তিনি বলেন, “আমাদের মোট সাতজনকে সেই রাতে ধরে নেওয়া হয়। এর মধ্যে দুইজন টাকা দিলে তাদের নিচ তলার হাজতে আটকে রাখে। আর আমাদের দোতলায় নিয়ে পেটাতে থাকে। যখন আমরা অজ্ঞান হয়ে যাই তখন আমাদের মেঝেতে ফেলে রাখে।”

রকি জানান, “পুলিশ সদস্যরা আমাদের বুকের ওপর লাফালাফি করে। পানি চাইলে মুখে থুতু দেয়। নির্যাতনে আমার ভাই মারা যায়। আমিও মারা যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছাই।”

তিনি বলেন, “যে দুজনকে হাজতে রাখা হয়েছিল, তাঁরা হাজত থেকে সব দেখেছেন এবং তাঁরা আদালতে সেগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। পুলিশ অনেক ভয়ভীতি দেখিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা আদালতে সত্য কথা বলেছেন। ব্লাস্ট আমাদের আইনগত সহায়তা দিয়েছে।”

২০১৪ সালের ৭ অগাস্ট জনির ভাই রকি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে ‘নির্যাতন ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ)-২০১৩ আইনে’ এই মামলাটি দায়ের করেছিলেন।

মানবাধিকার রক্ষায় বিরাট ঘটনা

পুলিশ হেফাজতে এক যুবককে হত্যার দায়ে তিন পুলিশসহ পাঁচজনকে কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়টিকে “মানবাধিকার রক্ষার জন্য বড়ো ঘটনা,” বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান।

তিনি বেনারকে বলেন, “এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, দেশে হেফাজতে মৃত্যু ঘটছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হচ্ছে।”

অধ্যাপক মিজানের মতে, গত ৩১ জুলাই কক্সবাজারের একটি পুলিশ চেক পয়েন্টে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, তদন্ত ও আজকের রায় “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এই ধারণা দেবে যে, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে যে কারও সাজা হতে পারে।”

২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনটি পাশ হওয়ার পর থেকে এর প্রয়োগ খুব বেশি হয়নি। এখন পর্যন্ত এই আইনে কতটি মামলা হয়েছে, তা নিয়ে তথ্যে অসঙ্গতি রয়েছে।

তবে গত ৯ জানুয়ারি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই আইনে ১৯টি মামলা দায়ের হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।