বাগেরহাটে পুলিশ হেফাজতে যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.09.29
ঢাকা
200929_Death-custody_1000.JPG হেফাজতে মৃতৃ নিবারণ আইনের মামলায় বাংলাদেশে প্রথম রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পল্লবী থানার সাবেক এসআই জাহিদুর রহমান খানকে ঢাকার আদালত থেকে বের করে নিয়ে আসছে পুলিশ। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বাগেরহাটে পুলিশ হেফাজতে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ করেছে পরিবার।

নিহত রাজা ফকির (২২) বাগেরহাট সদর উপজেলার খানজাহান আলী দীঘির পাড় এলাকার বাবু ফকিরের ছেলে। রাজা একটি হত্যা মামলার আসামি বলে পুলিশ জানিয়েছে।

বাবু ফকির মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, পুলিশ নির্যাতন করে তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে। অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে সাংবাদিকদের বলা হয়েছে, রাজা অসুস্থ ছিলেন।

গত বছর ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় বাগেরহাট সদর উপজেলার খানজাহান আলী মাজার মোড় এলাকায় ছুরিকাঘাতে রাজার বন্ধু তামিম মল্লিক (১৮) নিহত হন।

বয়সে ছোট তামিম আগের দিন কেন রাজা ফকিরকে সবার সামনে নাম ধরে ডেকেছিল, তা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি হয়, তামিমকে ছুরি দিয়ে আঘাত করলে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

ওই হত্যা মামলার প্রধান আসামী রাজা ফকির পলাতক ছিলেন।

রোববার দিবাগত রাতে পটুয়াখালী থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রাজা ফকিরকে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে বাগেরহাট নিয়ে আসা হয়।

বাবু ফকির অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে থাকা হত্যা মামলার বাদীপক্ষের সাথে যুক্ত হয়ে রাজাকে হত্যা করেছে পুলিশ।

তিনি জানান, পটুয়াখালী থেকে বাগেরহাট নিয়ে আসার পথে পুলিশ রাজাকে নির্যাতন করে। এছাড়া বাগেরহাট এনেও তারা রাজাকে নির্যাতন করেছে।

তিনি বলেন, রাজা একজন পুলিশের ফোন থেকে ফোন করে তাঁকে নির্যাতনের কথা জানায়।

“আমার ছেলেকে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে পিবিআই। আমি এর বিচার চাই,” বলেন বাবু ফকির।

এ বিষয়ে বেনারের পক্ষ থেকে বাগেরহাট জেলা পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে জেলার পুলিশ সুপারের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়।

রাজা ফকির একটি হত্যা মামলার আসামি জানিয়ে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় বেনারকে বলেন, “রাজা ফকির কীভাবে মারা গেল, তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া বলা যাবে না। এই রিপোর্ট আসতে আরও দুই-চার দিন সময় লাগবে।”

তবে “পুলিশ তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই,” বলেন পুলিশ সুপার।

এদিকে রাজা ফকিরকে পুলিশ মৃত অবস্থায় হাসপাতালে এনেছিল বলে বেনারকে জানান বাগেরহাট সিভিল সার্জন ডা. মো. হুমায়ূন কবির।

তিনি বলেন, “সোমবার দুপুরের দিকে রাজা ফকিরকে হাসপাতালে আনা হয়। আমাকে কর্তব্যরত ডাক্তার জানিয়েছেন যে তিনি রাজা ফকিরকে পরীক্ষা করে মৃত অবস্থায় পেয়েছেন।”

তিনি জানান, রাজা ফকিরের লাশের ময়নাতদন্ত বাগেরহাটে সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর শরীরে অভ্যন্তরীণ কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

“তবে সে কেন মারা গেছে তা জানতে ইনকোয়েস্ট প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে বলা যাবে না,” বলেন সিভিল সার্জন।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু খুব সাধারণ ঘটনা। মানবাধিকার কর্মীরা বহুদিন ধরে এ জাতীয় হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন।

নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ করতে ২০১৩ সালে সংসদে পাশ করা হয় একটি আইন।

এই আইন অনুযায়ী, গ্রেপ্তারের পর কোনো আসামির মৃত্যু হলে তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর বর্তাবে। এই আইনের আওতায় এজাতীয় মৃত্যুর জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান রয়েছে।

তবে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার বেনারকে বলেন, শুক্রবার পর্যন্ত রাজা ফকিরের বাবা পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করেননি।

এ পর্যন্ত নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা দায়ের হয়েছে বলে পুলিশ ‍সূত্রে জানা গেছে।

২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টর থেকে ইশতিয়াক হোসেন জনি নামে এক গাড়িচালক ও তাঁর ভাইকে ধরে নিয়ে আসে পুলিশ। পল্লবী থানায় নির্যাতনের এক পর্যায়ে মারা যান জনি।

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায় নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহতের ভাই।

গত ৯ সেপ্টেম্বর হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত রাজধানীর পল্লবী থানার তৎকালীন পুলিশের তিন কর্মর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত। অন্য দুই আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ওই আইনে পুলিশের সাজার ঘটনা এটিই প্রথম। তবে রাজা ফকির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আই​নে মামলা করা হবে কিনা, পরিবার এখন পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানান বাবু ফকির।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ার‌ম্যান ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টায় থাকেন। আইনকে তাঁরা মানবিক বিবেচনায় প্রয়োগ করতে পারেন না।”

“আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণে কোনো মৌলিক গলদ রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখারও সময় এসেছে,” বলেন ড. মিজানুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।