গ্রেনেড হামলা মামলা: বাবরের মৃত্যুদণ্ড, তারেকের যাবজ্জীবন
2018.10.10
ঢাকা
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় জড়িতদের দীর্ঘ ১৪ বছর পর সাজা দিয়েছে আদালত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ওই হামলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
বুধবার মামলার রায় ঘোষণার পর সরকারি কৌসুলী মোশাররফ হোসেন কাজল বেনারকে বলেন, “এই মামলায় জীবিত ৪৯ জন আসামির মধ্যে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন ১৯ জন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন আরো ১৯ জন। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ১১।”
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ও খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী।
সেদিন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন, যাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান ওই ঘটনায় আহত হয়ে পরে মারা যান।
অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদের মুফতি আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলের নাম অভিযোগ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
মোট ৪৯ আসামির মধ্যে ১৮ জন বর্তমানে পলাতক। তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন, হারিছ চৌধুরীর সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা যায়নি।
রায়ের আগে আটক ৩১ আসামির সবাইকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে নাজিমুদ্দিন রোডের আদালত ভবনে নেওয়া হয়।
রায় ঘোষণার পর তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়ার পথে প্রতিক্রিয়া চাইলে প্রিজন ভ্যান থেকে একজন বেনারকে বলেন, “মুফতি হান্নানের বানোয়াট কথার ভিত্তিতে এই রায় দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত বিচার হয়নি।”
মৃত্যুদণ্ড পেলেন যারা
রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) প্রধান মেজর জেনারেল (অব) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন (পলাতক), মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মো. ইউসুফ বাট ওরফে মজিদ বাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, শেখ ফরিদ ওরফে শওকত ওসমান, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাইদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ এবং মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির নেতা হারিছ চৌধুরী, সাবেক মুরাদনগর এমপি কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, মো. আরিফুল ইসলাম, শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, মুফতি আবদুর রউফ, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুরসালিন (ভারতের কারাগারে), মুত্তাকিন (ভারতের কারাগারে), জাহাঙ্গীর বদর, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা লিটন এবং মো. খলিল।
সাজাপ্রাপ্ত ১১ কর্মকর্তা
বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন হলেন, মেজর জেনারেল এটিএম আমীন (পলাতক), লে. কর্নেল (অব) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার (পলাতক), লে. কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহুদুল হুদা, আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান (পলাতক), ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, এএসপি আবদুর রশিদ, বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমীন এবং এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান।
বিএনপির প্রত্যাখান
বিএনপি এই রায় প্রত্যাখান করে বলেছে, এটি সরকারের ‘ফরমায়েশি রায়’। রায় ঘোষণার পর বিএনপি নেতারা জরুরি সভায় বসেন।
পরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায় সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। তারেক রহমানকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সাজা দেয়া হয়েছে। আমরা এই ফরমায়েশি রায় প্রত্যাখান করি।”
তারেক রহমানের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বেনারকে বলেন, “আমরা বিচার পাইনি। তারেক রহমান এই হামলার সাথে যুক্ত নন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাঁকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। আদালত আগামী ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে বলেছেন। রায়ের কপি হাতে পেলে আমরা আপিল করব।”
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, এই রায়ের বিরুদ্ধে সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীরা আগামী বৃহস্পতিবার থেকে সাত দিনের প্রতিবাদ কর্মসূাচি পালন করবে।
নাখোশ আওয়ামী লীগও
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, ১৪ বছর পর এই হামলার বিচারে তাঁর দল খুশি। তবে তিনি বলেন, “তবে আমরা পুরোপুরি খুশি নই।” তাঁর মতে, তারেক রহমান এই হামলার মূল হোতা। তার ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল।
রায়ের পর সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “এই হামলার মূল নায়ক তারেক রহমান। তিনি আওয়ামী লীগকে ও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সপাটে শেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন। মূল হোতা তারেকের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল।”
তিনি জানান, তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী বা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদের ফাঁসির জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে কি’না, সে ব্যাপারে রায়ের কাগজপত্র পাওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
এই রায় ‘ঐতিহাসিক’
বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. আতাউর রহমান এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাবেক মন্ত্রী, সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা, পুলিশ প্রধান ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের দায়িত্বে থাকাকালীন কৃতকর্মের জন্য বিচার করা হলো।”
“জাতীয় নির্বাচনের আগে এই রায় বিএনপির জন্য আরেক ‘রাজনৈতিক বিপর্যয়’। কারণ দেশের সাধারণ মানুষ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সমর্থন করেনি,” যোগ করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।