রোহিঙ্গা শিবিরে নেই আশ্রয়কেন্দ্র, পালানো ঠেকাতে কড়াকড়ি
2023.05.13
ঢাকা ও কক্সবাজার
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় এগিয়ে আসছে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা। এর পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়া হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র বাংলাদেশের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ পাশে ও টেকনাফ ঘেঁষে অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
শনিবার বিকেল থেকেই কক্সবাজার এলাকার বাসিন্দারা দলে দলে আশ্রয়কেন্দ্রে প্রবেশ করতে শুরু করে। সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টি শুরু হলেও ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে থাকতে হচ্ছে শিবিরেই। সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
পাহাড় ধস হলে রোহিঙ্গারা ঝুঁকিতে পড়বে বিবেচনায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির বাস্তবায়ন বোর্ডের জরুরি সভা শেষে দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে দেশের ছয়টি জেলায় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের নেতৃত্বে সাড়ে চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে। সেখানে পাহাড়ের ওপর জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা নেই কিন্তু বৃষ্টিপাতের কারণে ভূমিধস হতে পারে। এই আশঙ্কা মাথায় রেখে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুত থাকতে বলেছি।”
তিনি জানান, যেহেতু রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১২ লাখ, সেহেতু তাদের সরিয়ে নিয়ে কোনো আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেই আশ্রয়কেন্দ্র
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিস্থিতি সম্পর্কে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারনিউজকে বলেন, “ক্যাম্পের ভেতরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। তবে আমরা শিবিরের ভেতরের মসজিদ ও কমিউনিটি হলসহ কিছু ভবনকে অস্থায়ী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করেছি। ভূমিধস হলে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গার আশ্রয়ের প্রয়োজন হতে পারে।”
রোহিঙ্গা জনগণ পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করায় জলোচ্ছ্বাসের কারণে কোনো ঝুঁকির মুখে পড়বে না দাবি করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, “ঝড়ের সময় যাতে শরণার্থীরা তাঁদের ক্যাম্প থেকে বের হতে না পারে সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।”
ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, “ঘূর্ণিঝড় মোখার সুযোগে রোহিঙ্গা যাতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য এপিবিএনসহ সব সংস্থাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
“রোহিঙ্গারা যাতে দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হতে না পারে সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের অংশে আঘাত হানলে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে,” বলেন তিনি।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র ওলগা সাররাডো বলেছেন, “আমরা আশঙ্কা করছি ঝড়ের প্রভাবে অতিরিক্ত মাত্রায় বৃষ্টিপাতসহ ভূমিধস এবং সমুদ্রের কাছে শিবিরগুলো প্লাবিত হতে পারে।”
“শিবিরে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে,” আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক লাখ মানুষ
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাস বেনারকে বলেন, “রাত ৮টা পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ স্থানীয় মানুষ কক্সবাজারের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে প্রবেশ করেছে।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শনিবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ দেশের বিভিন্ন এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পৌনে তিন লাখেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
শনিবার রাতে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে দেওয়া বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে (ক্রমিক নম্বর ১৬) বলা হয়েছে, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা এখন আরও বেশি গতিতে উপকূলের দিকে এগোচ্ছে।
ঝড়টি ঘণ্টায় প্রায় ২২ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে আসছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতি বেড়ে যাওয়ার কারণে শনিবার মধ্যরাতেই চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় এর অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হতে পারে।
“ঘূর্ণিঝড়টি আরও উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে কাল রোববার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কক্সবাজার-উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে,” বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
রাজধানীতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি জানান, ‘ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আসছে। আমরা ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রেখেছি ও ঝড়টি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি।’
ঘূর্ণিঝড়ের সময় পানি জমে গেলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সুতরাং সেই সময়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, এই পদক্ষেপ (গ্যাস ও বিদ্যুত বন্ধ) সাময়িক দুর্ভোগ সৃষ্টি করলেও মানুষের জীবন রক্ষা পাবে।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আমরা এই ধরনের ব্যবস্থা নিব ও নিচ্ছি।’
আতঙ্ক বেড়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে
শনিবার বিকেল থেকে বৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ভূমিধসের আতঙ্ক বেড়েছে।
টেকনাফের জাদিমুড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি বজলুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমার ক্যাম্পে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। এর মধ্য বেশির ভাগই শিশু ও নারী। যাদের অধিকাংশ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন। বৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূমিধসের ভয় বাড়ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।”
কক্সবাজারের ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. ফারুক আহমদ বলেন, “উখিয়ায় আমাদের অধীনে ১১টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভূমিধসের ঝুঁকিতে যেসব রোহিঙ্গাদের বসতি আছে, তাঁদের সরিয়ে নিতে মাইকিং করা হচ্ছে। প্রাণহানি এড়াতে তাদের সরিয়ে আনা হবে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি।”
প্রতিবেদন তৈরিতে কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আব্দুর রহমান