ঘূর্ণিঝড় মোখা: উপকূলে মহাবিপদ সংকেত, ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো

কামরান রেজা চৌধুরী, আব্দুর রহমান ও সুনীল বড়ুয়া
2023.05.12
ঢাকা ও কক্সবাজার
ঘূর্ণিঝড় মোখা: উপকূলে মহাবিপদ সংকেত, ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো কক্সবাজারের একটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে মাইক দিয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় সতর্কতা ও প্রস্তুতি ঘোষণা করছেন একজন স্বেচ্ছাসেবক। ১২ মে ২০২৩।
[আব্দুর রহমান/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দিকে ধেয়ে আসছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। এর শক্তি বিবেচনায় নিয়ে শুক্রবার রাতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসহ উপকূলীয় আট ১২ জেলায় ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডর আঘাত হানার পর আরেকটি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং এর ফলে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি রোববার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলা এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে আঘাত করতে পারে। তখন বাতাসের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২১ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

অধিদপ্তরের মতে, বঙ্গোপসাগরের কোলে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত কক্সবাজার জেলাসহ উপকূলে ৮ থেকে ১২ ফুট জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জানিয়েছে, মোখার প্রভাবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে জলোচ্ছ্বাস এবং ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে মানবিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও পটুয়াখালীতেও আঘাত করতে পারে

মোখার ক্ষয়ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার মতো আশ্রয়কেন্দ্র কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফে নেই। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মোখা আঘাত হানলে রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ির প্রায় অধিকাংশই ভেঙে যেতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বৃহস্পতিবার এক সভায় সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এবং এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করেছে।

কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমরা কেউই ঘূর্ণিঝড় ঠেকাতে পারব না, সম্ভবও না। এখন আমাদের চেষ্টা হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতি যাতে কম হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করা।”

তিনি বলেন, “মানুষ সরিয়ে নিতে হবে। আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রের স্বল্পতা রয়েছে। তাই, আমরা বলেছি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনাকে যেন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, অনেকের বাড়ি-ঘর টেকসই। তাঁরাও যেন মানুষদের আশ্রয় প্রদান করেন।”

তাজুল ইসলাম বলেন, “সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সংসদীয় কমিটির সদস্যরাও সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।”

মোখা কেবলমাত্র কক্সবাজার জেলায় আঘাত করবে এমন পূর্বাভাসের সাথে দ্বিমত পোষণ করছেন অনেকেই।

দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আব্দুল লতিফ খান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মোখা টেকনাফের চেয়ে মিয়ানমারের রাখাইনে বেশি ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এটি আমাদের দিকে বেশি ক্ষতি করতে পারে। এটি দক্ষিণের চেয়ে উত্তর দিকে অর্থাৎ টেকনাফের দিকে প্রবল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”

তিনি বলেন, “এছাড়া, বাংলাদেশের দক্ষিণ কেন্দ্রীয় জেলা যেমন চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও পটুয়াখালী এলাকায় আঘাত করতে পারে মোখা। এর কারণ হচ্ছে, বর্তমানে এলাকাগুলোর উপকূলের তাপমাত্রা খুব বেশি। তাপমাত্রা বেশি হলে সেখানে সাইক্লোন আঘাত হানার সম্ভাবনাও থাকে বেশি।”

আব্দুল লতিফ খান বলেন, “এখন পর্যন্ত যে প্রবণতা তাতে প্রতি ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বাংলাদেশে আঘাত করতে পারে। সে ক্ষেত্রে উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যেসব ঘর আছে সেগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে।”

“উখিয়ায় ভূমিধসের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। উখিয়া-টেকনাফে যত সংখ্যক স্থানীয় অধিবাসী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে তাদের সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার মতো আশ্রয়কেন্দ্র সেখানে নেই।”

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “টেকনাফে ১০১টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা গড়ে ৭০০ হলে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ৫০০ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। টেকনাফের স্থানীয় জনগণের সংখ্যা আড়াই লাখ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় চার লাখ।”

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, “জেলার উপকূলীয় এলাকার সব সাইক্লোন শেল্টার হোম ও বিদ্যালয়সহ ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। তবে জনসংখ্যার তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক কম।”

ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শিবির

উখিয়া টেকনাফের ৩৩টি শিবিরে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস।

এসব শিবিরে বাড়ি-ঘর বাঁশ, টিন, পলিথিন দিয়ে নির্মিত যা ঝড়ে টিকে থাকার সম্ভাবনা কম।

সরকারের অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু দ্দৌজা নয়ন বেনারকে বলেন, “কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৩টি শরণার্থী ক্যাম্প রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে সবকটি শিবির ঝুঁকির মুখে পড়বে।”

“এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে অন্যত্র সরানো সম্ভব নয়। এতগুলো আশ্রয় কেন্দ্রও নেই। শিবিরের আশেপাশে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “তবুও আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। মাইকিং করে তাঁদের সতর্ক করছি যেন তাঁরা নিরাপদে থাকেন।”

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ১০ লাখ ৩০ হাজার নগদ টাকা, ৪৯০ মেট্রিক টন চাল, ৭ মেট্রিক টন শুকনো খাবার, ১৯৪ বান্ডিল ঢেউ টিন মজুদ রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “টেকনাফে সাতটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে এমন ৫০০ পরিবার চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের সরিয়ে নেওয়া হবে।”

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে ক্যাম্পের সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ছেড়ে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের পাশের স্কুল এবং খাদ্য বিতরণ সেন্টারে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।”

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছাড়ছে মানুষ

টেকনাফের অদূরে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে দলে দলে মানুষ টেকনাফে আশ্রয় নিচ্ছেন।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম জানান, “দ্বীপের চারদিকে পানি। সকালে বাতাসের গতি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির ঢেউ বেড়েছে। আমরা ভয়ে পরিবার নিয়ে টেকনাফে চলে এসেছি। আমাদের মতো অনেকে দ্বীপ ত্যাগ করেছেন।”

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আরেক বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, “বিকেলে থেকে সমুদ্রের ঢেউ বেড়েছে। ফলে দ্বীপের অনেক মানুষ ভয়-ভীতির মধ্য আছেন। আজকেও প্রায় ৫০০ মানুষ দ্বীপ ছেড়েছে। মূলত সচ্ছল পরিবারের লোকজন দ্বীপ ছাড়ছে। গত কয়েক দিনে প্রায় দুই হাজারের মতো মানুষ দ্বীপ ছেড়েছে।”

ঘূর্ণিঝড় মোখার পরিস্থিতি বিবেচনায় উপকূলে ফিরতে শুরু করেছেন কক্সবাজারের জেলেরা। এরই মধ্যে উপকূলে নোঙর করেছে তিন হাজারের কাছাকাছি মাছ ধরার ট্রলার।

এফবি তরঙ্গ ট্রলারের মাঝি আবু তৈয়ব বলেন, “সাগর উত্তাল, বাতাস বেড়েছে। তাই মাছ শিকার না করে আমরা ২১ জেলে উপকূলে ফিরে এসেছি।”

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সাড়ে তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে জানিয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুজ্জামান বলেন, “আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মূলত সাগরের বুকে জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের থেকে সেটি বিচ্ছিন্ন। দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্বীপের জন্য আমাদের নৌবাহিনীও প্রস্তুত রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি।”

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বেনারকে বলেন, “উপকূলের লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার সেই পরিস্থিতি এখনো হয়নি। তবে দ্বীপবাসীকে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে। দ্বীপে হোটেলসহ ৩৭টি আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি এক হাজার ৩০০ স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে অনেক মানুষ দ্বীপ ছেড়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।