সাম্প্রদায়িক সংঘাতে বিধ্বস্ত দিল্লি: মৃত্যু বেড়ে ৩৭
2020.02.27
কলকাতা ও ঢাকা
বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে গত চারদিনের চলমান সহিংসতায় আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে ভারতের রাজধানী দিল্লি।
কয়েক দশকের মধ্যে দিল্লির বুকে এমন ভয়ঙ্কর হামলা আর হয়নি উল্লেখ করে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। মসজিদ, মাদ্রাসা এবং মুসলমানদের বাড়ি ও দোকানে আগুন দিয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা।
দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্টজন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তাঁদের আশঙ্কা ভারতের সহিংসতা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
বুধবার দিল্লির মৌজপুরে আক্রান্ত একটি হিন্দি নিউজ ওয়েব পোর্টালের সাংবাদিক সুশীল মানব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, হামলাকারীদের কাছে কীভাবে তাঁকে প্যান্ট খুলে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তিনি হিন্দু।
তিনি যখন তাঁর পোর্টালের জন্য ফেসবুক লাইভ করেন ঠিক তখনই লাঠি, রড ও পিস্তল হাতে একদল উন্মত্ত জনতা তাঁকে ঘিরে ধরে।
চারদিনের এ সাম্প্রদায়িক হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয়। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।
বৃহষ্পতিবার নতুন করে হিংসার ঘটনা না ঘটলেও উত্তর পূর্ব দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভাঙা ও পোড়া যানবাহন রাস্তার ধারে পড়ে রয়েছে। আগুন জ্বলতে থাকা ভবনগুলো থেকে এখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
দিল্লির নবনিযুক্ত স্পেশাল কমিশনার এস এন শ্রীবাস্তব বৃহস্পতিবার উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের বলেন, “পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মানুষকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমরা তাঁদের সঙ্গে রয়েছি।”
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বৃহষ্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, গত বুধবার থেকে সহিংসতা কমে এসেছে। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দেবার কথাও তিনি ঘোষণা করেন।
‘প্রশাসন তৎপর হলে দাঙ্গা রোখা যেত’
গত রবিবার রাত থেকে বিতর্কিত নাগরিক আইনের বিরোধী ও পক্ষের বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। মূলত উত্তর পূর্ব দিল্লির মুসলিম অধ্যুষিত মৌজপুর, ভজনপুরা, গোকুলপুরী, মুস্তাফাবাদ, জাফরাবাদ, শিব বিহার, চাদবাগ প্রভৃতি এলাকায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
গত রবিবার বিকেলে দিল্লিতে বিজেপির এক বিতর্কিত নেতা কপিল মিশ্রর প্ররোচনামূলক ভাষণকে অনেকে দাঙ্গার জন্য দায়ী করেছেন।
গোকুলপুরীর বাসিন্দা রহিমউদ্দিন শেখ টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “প্রশাসন ও পুলিশ তৎপর হলে দাঙ্গা রুখে দেওয়া যেত। হয়তো কোনো উদ্দেশ্যে তা করা হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “রবিবার রাত থেকে কানাঘুষোয় শুনতে পেয়েছিলাম, গন্ডগোল হতে পারে। শেষপর্যন্ত সেটা হলো। মসজিদে আগুন দেওয়া হলো। কোরান ছুঁড়ে ফেলা হল। মসজিদের মিনারে লাগিয়ে দেওয়া হলো জয়শ্রীরাম পাতাকা। মাদ্রাসাতেও আক্রমণ করা হলো।”
দিল্লির ঘটনায় উদ্বিগ্ন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্বর্তী সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল বৃহষ্পতিবার রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দেয়।
রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সোনিয়া গান্ধী বলেন, রাষ্ট্রপতিকে দুটো বিষয় পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন। এক, দেশের মানুষ যেন পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকেন, কারও যেন প্রাণহানি না ঘটে। দুই, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ। সে কারণে তাঁর পদত্যাগেরও দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশে উদ্বেগ
“আমরা ভারতের রাজধানী দিল্লীতে চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন,” মন্তব্য করে বাংলাদেশের ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতি দিয়েছেন।
ভারতে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে তা পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহেও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে মন্তব্য করে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “সহিংসতার বিরুদ্ধে সম্প্রীতির সচেতন জাগরণ সকল ধর্মান্ধতাকে রুখে দেবে, এ আমাদের বিশ্বাস।”
এদিকে ভারতে চলমান সহিংসতা প্রসঙ্গে দেয়া এক বিৃবতিতে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি জানায়, ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষ ও বিপক্ষ গোষ্ঠীর মধ্যে যে বিরোধ ছিল তা ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নিয়েছে’।
বিএনপি এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এ আইন পাশের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া এই উপমহাদেশ তথা এ অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
ভারত সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই চলমান সংকটের সমাধান করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় বিএনপির বিবৃতিতে।
এদিকে দিল্লিতে মুসলমান হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে মুজিব বর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আগামী ১৬ মার্চ ঢাকায় আসার কথা রয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর।
বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সরকারের কাছে এ দাবি জানান তিনি।
তবে হেফাজতে ইসলামের প্রধানের এই দাবিকে অশোভন বলে মন্তব্য করে ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বেনারকে বলেন, “আমি মনে করি দাওয়াত বাতিল করা কোনো সভ্য কাজ নয়।”
“নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভারতে যা হচ্ছে তা দুঃখজনক,” মন্তব্য করে বাদশা বলেন, “আমরা আশা রাখি ভারত তার ধর্ম নিরপেক্ষ ঐতিহ্য রক্ষা করবে।”
নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে এসে হয়তো এব্যাপারে ‘বাংলাদেশের উদ্বেগের ব্যাপারে কিছু বলবেন,’ আশা করেন বাদশা।
“নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে ভারতে যা হচ্ছে তা কাঙ্খিত নয়,” মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সরকার চাইলে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় তাঁকে এই বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানাতে পারে।”
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খানের মতে, ‘“বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ।”
“ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কিছু নেই,” বেনারকে বলেন ফারুক খান।