ডেঙ্গু জ্বরে ছেলে হারিয়েছেন, মেয়েকে নিয়ে ভয়, নিজেও হাসপাতালে

শরীফ খিয়াম
2019.08.05
ঢাকা
190805_Dengue_1000.JPG ঢাকার একটি হাসপাতালের মেঝেতে কয়েকজন ডেঙ্গু রোগী। ২ আগস্ট ২০১৯।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

ডেঙ্গু জ্বরে ছেলে হারিয়ে নিজে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সোমবার সিটি মেয়রের প্রতি কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি এখন শিশুকন্যার নিরাপত্তা চান।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কর্মরত ওই নারী কর্মকর্তার প্রশ্নটি হচ্ছে—“গত অর্থ বছরে রাষ্ট্র ৬৬৫ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে পেরেছে। আমি রাষ্ট্রের দেয়া গুরু দায়িত্ব পালন করেছি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। কিন্তু মাননীয় মেয়র, রাষ্ট্র কি আমার বাচ্চার নিরাপত্তা দিতে পেরেছে?”

ছেলের মৃত্যুর শোক না কাটতেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ছয়দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎ​সাধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপ কর কমিশনার চাঁদ সুলতানা চৌধুরানীর এই স্ট্যাটাস ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তাঁর ক্ষোভ ও হতাশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা এডিস মশা মারতে ব্যর্থ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেয়রকে মূলত দুষছেন।

গত ৫ জুলাই সাত বছর বয়সী সন্তান ইরতিজা শাহাদ প্রত্যয়কে হারানো এই মা এখন তাঁর কনিষ্ঠ কন্যাকে নিয়েও শঙ্কিত। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, “আমার মেয়ের দুই বছর বয়সে একবার ডেঙ্গু হয়েছিল! আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারেন আমার মেয়ের আর ডেঙ্গু হবে না?”

“নাকি আমার এই লেখাটিও আপনার কাছে একটি গুজব,” মেয়রকে উদ্দেশ্য করে এমন প্রশ্নও রেখেছেন তিনি।

এর আগে গত ২৫ জুলাই ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন দাবি করেন, সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে ছেলেধরার মতো গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

“কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে ডেঙ্গু আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে তা কাল্পনিক,” বলেছিলেন তিনি। ওই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সোমবার দুপুর দেড়টায় প্রকাশিত সুলতানার ওই ‘ফেসবুক স্ট্যাটাস’ রাত সাড়ে নয়টার মধ্যেই সহস্রাধিকবার ‘শেয়ার’ হয়েছে।

একদিনে সাত মৃত্যু

ডেঙ্গু জ্বরে রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় সর্বোচ্চ সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় পাঁচ জন ও ঢাকার বাইরে দুই জন মারা গেছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪ বছর বয়সী ভোলা জেলার মো. হাসান ও ২৩ বছর বয়সী দীপালী আক্তারের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের সহকারি পরিচালক (প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন।

রোববার রাত নয়টার দিকে ঢাকার মুগদা ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ইডেন কলেজের ছাত্রী ইভা ইক্তার (২৮)। এর আগে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোববার দিবাগত মধ্যরাতে সাত বছরের শিশু ইফরিত হোসেনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেন তার খালা মিতু।

সোমবার ভোরে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ঢাকার আবহাওয়াবিদ নাজমুল হোসেনের ছয় মাসের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা শারমিন আরা।

খুলনায় বেসরকারি সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকালে খাদিজা বেগম (৪০) এবং মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোববার সাড়ে ১২টার দিকে মারা যান রিপন হাওলাদার (৩২)। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল এই দুটি মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে।

মৃত্যুর তথ্যে অসঙ্গতি

ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুর তথ্য নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি হিসেবে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর হিসেবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন অন্তত ৯৪ জন। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের হিসেবে এই সংখ্যা ষাটের বেশি।

তবে সরকারি হিসেব বলছে, মৃতের সংখ্যা মাত্র ১৮।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গুতে ১৮ জন মারা যাওয়ার যে তথ্য আমরা প্রকাশ করেছি, সেটিই সঠিক। এর বাইরে যেগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো সুনিশ্চিত হিসাব নয়।”

“রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালকের তত্ত্বাবধানে মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি রয়েছে। তাঁরা পরীক্ষা করে যখন কোনো মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু বলে নিশ্চিত করেন, তখন সেটা আমরা ঘোষণা করি,” বলেন তিনি।

“মোট ৩২টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে আমরা ১৮ জনের কথা নিশ্চিত করেছি,” উল্লেখ করে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা বেনারকে বলেন,বলেন, “এটাই চূড়ান্ত হিসাব।”

তাঁর মতে, যেহেতু অনেক রকম তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, তাই এই পর্যালোচনা করতে একটু সময় লাগে। তবে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য প্রত্যাখান করেননি তিনি।

ডা. মীরজাদী জানান, গণমাধ্যমগুলো সাধারণত হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর খবর পায়। তবে হাসপাতালগুলো মূলত মৃত্যুর ‘সম্ভাব্য কারণ’ জানায়। কারণ যারা রোগীর চিকিৎসা করেন, তারা মৃত্যুর কারণ শুধু ডেঙ্গু কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারেন না।

“যে কারণে এক্ষেত্রে সব দেশেই একটি ‘ডেথ রিভিউ কমিটি’ করা হয়। এই কমিটি সামগ্রিক তদন্ত, রক্ত পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা করে ‘মৃত্যুর কারণ’ চূড়ান্ত করে,” বলেন তিনি।

মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি মূলত তিন শ্রেণিতে মৃতদের চিহ্নিত করে। ০১. ডেঙ্গু আক্রান্ত নয়, ০২. ডেঙ্গু আক্রান্ত, তবে মৃত্যুর কারণ আলাদা এবং ০৩. ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যু।

“মনে করেন ৪০ বছর বয়সী একজনের ডেঙ্গু রোগ ধরা পড়ার পরদিনই তিনি হার্টএ্যাটাকের কারণে মারা গেছেন। এটাকে ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যু বলা হবে না,” বলেন ডা. সাখাওয়াত। তিনি আরও বলেন, “কিন্তু প্রাথমিকভাবে এগুলোও ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যু বলে মনে করা হচ্ছে।”

আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই

দেশজুড়েই ডেঙ্গু পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হচ্ছে। সরকারি হিসেবে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৬৫ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বেনারকে জানান, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে সোমবার পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ভর্তি হয়েছেন ২৭ হাজার ৪৩৭ জন।

“তাঁদের মধ্যে বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি সাত হাজার ৬৫৮ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৯ হাজার ৭৬১ জন,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।