ঢাকার আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকবে না
2016.04.04

যুগ যুগ ধরে ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকায় অবৈধ ও অননুমোদিত বাণিজ্যিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও এখন সরকারের টনক নড়েছে।শহরজুড়ে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা মিলেমিশে একাকার হওয়ার পর সরকার বলছে, আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না।
মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে গতকাল সোমবার আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় মাস। এই সময়ের মধ্যে আবাসিক এলাকা থেকে বৈধ বা অবৈধ সব ধরনের ব্যবসায়িক, বাণিজ্যিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সরাতে হবে।
সরকারের হিসাবে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আবাসিক এলাকায় অননুমোদিত বাণিজ্যিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪ হাজার ৬৯৪টি। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) এ সংখ্যা কয়েক হাজার।
গতকাল সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে অননুমোদিত ছাড়াও কেউ কৌশলে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ার অনুমোদন নিয়ে থাকলে তাও সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, আবাসিক এলাকার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনতে এবং পরিকল্পিত শহর গড়তে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে আবাসিক এলাকার অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—রাজউক, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সমন্বিত অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গত বছরের ৮ জুন মন্ত্রিসভা আবাসিক এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুশাসন দেয়। গতকাল সেই প্রতিবেদন মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সেবা প্রত্যাহার করা হবে
মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলা হয়, ছয় মাসের মধ্যে আবাসিক এলাকায় যেসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকবে, সেগুলোর সেবা প্রত্যাহার করবে সরকার।পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেওয়া হবে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বাতিল করবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কোনো কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) নেওয়া হবে না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মন্ত্রী বলেন, সরকার যদি ভ্যাট বা ট্যাক্স নেয়, তাহলে অবৈধ প্রতিষ্ঠান এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যাবে।
আগে সমঝোতার চেষ্টা
বৈঠক সূত্র জানায়, আবাসিক এলাকায় অনুমতি নিয়ে কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল গড়ে তুললেও তা সরাতে হবে। এ জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বুঝিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করা হবে সবার আগে। এতে কাজ না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
“এই উচ্ছেদ নিয়ে আতঙ্ক বা ভয়ভীতি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে জন্য ধীরেসুস্থে, আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে কাজগুলো করা হবে,” বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরানো হলে সেখানে কর্মরতদের রুটি–রুজির বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ জানান।
চারটি সিদ্ধান্ত
মন্ত্রিসভা গতকাল চারটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথম সিদ্ধান্ত হচ্ছে; আবাসিক এলাকায় পার্কিংয়ের জন্য রাখা জায়গায় গাড়ি রাখতে হবে। সেখানে কোনো স্থাপনা করা হয়ে থাকলে তা অপসারণ হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহরে যানজটের বড় কারণ হচ্ছে আবাসিক এলাকায় পার্কিং না থাকা। বাড়ি নির্মাণের সময় পরিকল্পনায় পার্কিং থাকলেও পরে সেখানে ফ্ল্যাট বা দোকানপাট নির্মাণ করা হয়।এগুলো উচ্ছেদ করার দাবি দীর্ঘদিনের।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, আবাসিক এলাকায় কোনো বার বা মদের দোকান স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে না। এ ধরনের দোকান নির্মাণ করা হয়ে থাকলে সেটি সরিয়ে ফেলতে হবে। এমনকি অনুমতি নিয়ে এটা করা হলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আবাসিক এলাকা থেকে অতিথিশালা (গেষ্ট হাউস) ও আবাসিক হোটেল সরানোরও পরামর্শ দেওয়া হয় মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে। এ জন্য এর মালিকেরা ছয় মাস পর্যন্ত সময় পাবেন।
এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় কে, কীভাবে অনুমতি দিল প্রয়োজনে তাও খতিয়ে দেখা হবে।
ঢাকাকে বাঁচাতে এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন জরুরি
জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়ায় ঢাকায় বহুমুখী সংকট তৈরি হয়েছে।এখনই উদ্যোগ না নিলে শহরটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই।
“ নানা অব্যবস্থাপনা থেকে ঢাকাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া এখনই জরুরি। মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। আবার খেয়াল রাখতে হবে, এর ফলে যাতে ব্যবসা–বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রধানমন্ত্রী তেমনই পরামর্শ দিয়েছেন,” বেনারকে জানান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, যিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে গতকাল অংশ নেন।
“রাজধানীর আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মাশুল আমরা দিচ্ছি,” বেনারকে জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালের পর আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করা হয়। তারপরও আবাসিক এলাকাগুলোয় বহু দোকান, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ জন্য দায়ী রাজউকসহ সরকারের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
মেয়র বলেন, “আবাসিক এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশের পার্কিংয়ের জায়গা নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য নানামুখী সমস্যা তৈরি করে।”