বাংলাদেশের উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে প্রয়োজন ঢাকার রূপান্তর

জেসমিন পাপড়ি
2017.07.19
ঢাকা
অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভবন। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভবন। এপ্রিল ২৭, ২০০৮।
নিউজরুম ফটো

বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর অন্যতম হলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পূর্বাঞ্চলে এখনো ভূমির প্রাপ্যতা রয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে অবশ্যই পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে এ শহর সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। এখনই সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু না করলে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতার আরও অবনতি ঘটবে।

বুধবার ঢাকায় বিশ্বব্যাংক আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে দিনব্যাপী এ সম্মেলনে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, ঢাকার দুই মেয়র এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।

বিশ্বব্যাংক জানায়, মহানগরীর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ঢাকাকে অবশ্যই সঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সমন্বয় সাধন এবং বিনিয়োগের সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে, বিশ্বব্যাংক এই মহানগরীর রূপান্তরে ঘটাতে সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে।

তবে কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বেনারকে বলেন, “ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে একটি পরিকল্পিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। কয়েকবার সেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নে অনীহাযুক্ত সরকারি ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনমুখীতার কারণে বসবাসযোগ্য করাটা এখন পরাবাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।”

তাঁর মতে, “সেটা বাস্তব করতে হলে কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। ধর্ম, বর্ণ রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিচারে সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে।”

তবে এই সদিচ্ছা বর্তমান সরকারের রয়েছে জানিয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ বেনারকে বলেন “বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাপকভাবে ঢাকা উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। যার বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নও হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই আমরা এগুচ্ছি।”

বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ (২০১৬) জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার জন।

সেমিনারে দেওয়া বক্তব্যে মন্ত্রী বলেন, “ঢাকার আয়তন দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ হলেও জিডিপির ৩৬ শতাংশ এ শহরটি থেকে আসে। এ কারণে রাজধানীকে কেন্দ্রে রেখেই আমরা উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছি।”

“ঢাকায় ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) ও বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কাজ চলছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ শহরের উন্নয়নমূলক আরও বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব বাস্তবায়িত হলে শহরের অবস্থা পাল্টে যাবে,” বলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী।

যানজটে দৈনিক নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা

সম্মেলনে ঢাকাকে একটি আধুনিক নগরী বানানোর সুযোগ নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান।

তাঁর মতে, অপরিকল্পিত এবং অগোছালোভাবে জনবহুল নগরী ঢাকার বিস্তার হয়েছে। এর ফলে তীব্র যানজট, বাসযোগ্যতার নিম্নমান, বন্যা এবং ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।

চিমিয়াও ফান বলেন, “বিগত ১০ বছরে যানচলাচলের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিমি থেকে ৭ কিমি পর্যন্ত নেমে এসেছে, যা পায়ে হেঁটে চলার গড় গতি থেকে একটু বেশি। ঢাকায় যানজটের কারণে দিনে ৩২ লাখ কর্ম ঘণ্টা নষ্ট হয়।”

পূর্ব সাংহাই এর পুডং এলাকা ও অন্যান্য স্থানের উদাহরণ টেনে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মার্টিন রামা বলেছেন, “যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি, বাসযোগ্যতার উন্নতি এবং যানজট নিরসন করতে পারে।”

তিনি বলেন, “ঢাকার বিশাল ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিবেচনায়, যথাযথভাবে পূর্ব ঢাকার টেকসই উন্নয়ন, অত্যধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো রেট্রোফিট করার প্রয়াসের চেয়ে অনেক কার্যকর ও অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক হবে। এখনই এ কাজ করার সঠিক সময়।”

সম্মেলনে ভারতের দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত এবং চীনের সাংহাইয়ের সাবেক ভাইস মেয়র কিঝেং ঝাও দিল্লি এবং পূর্ব সাংহাই এর পুদং এলাকার রূপান্তরের ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। এই দুটি মহানগরী একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সমন্বয় প্রয়াসের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বমূলক সহযোগিতা থেকে লাভবান হয়েছে।

পূর্বাঞ্চলকে পরিকল্পিত নগরায়ণের তাগিদ

বিশ্বব্যাংক বলছে, মহানগরীর দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে ঢাকার নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সামঞ্জস্য রাখতে পারেনি। ফলে একটি বিশৃঙ্খল ও অসম নগরায়ণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রায় ৩৫ লাখ বস্তিবাসীসহ অনেক অধিবাসী প্রায়ই মৌলিক সেবা, অবকাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেছেন, বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে, ঢাকা মহানগরীতে ২০৩৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বেড়ে হবে ৩ কোটি ৫০ লাখ। এই পর্যায়ের উৎপাদনশীল ও বাসযোগ্য একটি মহানগরী সেখানকার নাগরিকদের জন্য ও অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, রাজধানীর পূর্বাঞ্চল এলাকাটি এখনো গ্রামীণ। এলাকাটি মহানগরীর মূল কেন্দ্রের খুব কাছাকাছি এবং সেখানে ভূমির ব্যাপক প্রাপ্যতা রয়েছে যা মহানগরীর অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এবং বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে।

সম্মেলনে ‘পূর্ব ঢাকার জন্য এক নতুন উদাহরণ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা। এতে বলা হয়, মহানগরীর এলাকার প্রায় ৪০ শতাংশের সমান পূর্ব ঢাকা, গুলশানের মতো সমৃদ্ধ এলাকার ৫ কিমির মধ্যে অবস্থিত, যা এ লক্ষ্যে আর্থিক ও মানব সম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নে সহায়তা করতে পারবে। সঠিক ব্যবস্থাপনা করা হলে পূর্ব ঢাকার উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

ঢাকার এই পূর্বাঞ্চল নিয়ে কিছু পরিকল্পনা করা হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ইকবাল হাবিব জানান, ১৯৯৭ সালে ঢাকার পূর্ব দিকে একটি বাঁধ দেওয়া পরিকল্পনা করা হয়। বাঁধটা হয়নি। কিন্তু বাঁধের কথা মাথায় রেখে ব্যাপক জমি দখল ও উন্নয়ন হয়ে গেছে। এতে করে সেই বাঁধ ও বাঁধের সঙ্গে ওয়াটার ডিটেনশন এরিয়া এবং নিম্ন প্লাবন অঞ্চলের সমন্বয়ে থাকা প্রচুর খালের অস্তিত্ব সব হারিয়ে গেছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।