অনিশ্চয়তায় শহীদুল আলমের জামিন

কামরান রেজা চৌধুরী ও শরীফ খিয়াম
2018.10.08
ঢাকা
অনিশ্চয়তায় শহীদুল আলমের জামিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে গণ সংহতি আন্দোলনের মানববন্ধন। ঢাকা, অক্টোবর ৩, ২০১৮।
বেনার নিউজ

অনিশ্চয়তায় পড়েছে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় আটক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহীদুল আলমের জামিন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচবার চেষ্টা করে জামিন পেতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।

দ্বিতীয় দফায় হাইকোর্টে তার জামিন শুনানি শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় গত রোববার বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি মুজিবুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ শহিদুল আলমকে কেন জামিন দেওয়া হবে না তা জানাতে রুল জারি করেছে।

জবাব দিতে সরকারকে সাত দিন সময় বেঁধে দিয়েছে আদালত। তবে ঢাকা বারের সদস্য ও আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “এখানে নির্ধারিত সাত দিনের মধ্যেই সরকার জবাব দেবে সে নিশ্চয়তা নেই। সরকার ইচ্ছা করলে কালক্ষেপণ করতে পারে। সময় নিতে পারে।”

“এই রুল জারির মূল উদ্দেশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের মতামত জানা। কারণ জামিনের বিষয়ে আদালতের দুই পক্ষকেই শুনতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

“আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সরকার অসীম ক্ষমতার মালিক ” জানিয়ে প্রকাশ বলেন, “হাইকোর্টের রুল দেওয়ার ফলে শহিদুল আলমের জামিন প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হলো বলা যায়। সরকার বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখতে চাইলে জবাব দিতে বাড়তি সময় চাইতে পারে।”

শহীদুলের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা জানি না সরকার কত দিনে রুলের জবাব দেবে। সেটা সরকার বলতে পারবে। তবে, শহিদুলের জামিন নিয়ে যা হচ্ছে তা অস্বাভাবিক।”

শহীদুলের স্ত্রী অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ বেনারকে বলেন, “আশাবাদী কি না জানি না। তবে আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।” কারারুদ্ধ হলেও সংবিধান অনুযায়ী শহীদুলের নাগরিক অধিকার রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বেনারকে বলেন, “আমরা আদালতের আদেশ হাতে পেলে সেই অনুসারে জবাব দেব।”

 

ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি

এদিকে  গত ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এর মাধ্যমে  সোমবার থেকে কার্যকর হয়েছে বহু বিতর্কিত এই আইন।

এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বেনারকে বলেন, “কয়েকটি সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রপতিকে বিলটি ফেরত পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রপতি তাদের কথা রাখেননি।”

গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে এই আইনের নয়টি ধারা নিয়ে দেশের মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের লিখিত আপত্তি ও প্রয়োজনীয় সুপারিশগুলোর ব্যাপারে মন্ত্রিসভায় আলোচনার আশ্বাস দিয়েছিলেন সরকারের তিন মন্ত্রী।

ওই আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ২৯ সেপ্টেম্বর ঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচি স্থগিত করে পরিষদ।

“সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এরই মধ্যে আইনটি কার্যকর হওয়ার খবর নিশ্চয় উদ্বেগের”- বেনারকে বলেন সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ হয়েছেন মতিউর রহমান চৌধুরী।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিনের এই প্রধান সম্পাদক জানান, তাদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দেশের বাইরে আছেন। তিনি ফিরলে বৈঠক করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অন্যদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে বেরিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, অনেকগুলো এজেন্ডা থাকায় এটি বৈঠকে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

তবে এ ব্যাপারে বুলবুল বেনারকে বলেন, “আমরা (সাংবাদিকেরা) মন্ত্রীদের আশ্বাসে আস্থা রাখতে চাই।”

একই দিনে ঢাকায় ডিজিটাল  আইন বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন আরও পাকাপোক্ত করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর করা হয়েছে।”

সংসদের ভেতরে-বাইরে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি, উদ্বেগ ও মতামত উপেক্ষা করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে ২২ সেপ্টেম্বর  বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে ২৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে সম্পাদক পরিষদ।

পরে ২৬ সেপ্টেম্বর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠান। যাতে কর্মসূচি স্থগিত করে ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে সচিবালয়ে বৈঠকে বসার আহ্বান জানানো হয়।

চিঠিতে বলা  হয়েছিল, “বর্তমান সরকার আলোচনায় বিশ্বাসী। আমি বিশ্বাস করি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিকের যে আপত্তি রয়েছে তা আলোচনার মাধ্যমেই দুর করা সম্ভবহবে।”

তথ্যমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে সম্পাদক পরিষদ কর্মসূচি স্থগিত রেখে বৈঠকে অংশ নিতে রাজি হয়।

তবে সম্পাদক পরিষদ থেকে বলা হয়, “আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।”

তথ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের পর সম্পাদকেরাও আশা প্রকাশ করেন যে, আলোচনার মাধ্যমেই গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনার পর সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে তারা আবারও বসবেন জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, “সংসদে বিল পাস হলেও রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর না করায় বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার সুযোগ রয়েছে।”

তবে গত ৩ অক্টোবর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেন।

“যেসব সাংবাদিক মিথ্যে কথা লেখেন না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তাদের উদ্বেগের কিছু নেই। যারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে কথা লেখে, আমাদের ঘায়েল করার জন্য যারা বসে আছে, তাদেরই এ বিষয়ে দুশ্চিন্তা হবে,” বলেন তিনি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের কথা বলা বলেও এর চারটি ধারায়  বিতর্কিত সেই ধারার বিষয়গুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে।  এ ছাড়া পুলিশকে পরোয়ানা ও কারও অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

এই আইনে ঢোকানো হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলের সমালোচিত আইন ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’।

আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য। বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বসে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক এই আইন লঙ্ঘন হয়, এমন অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে।

মতিউর রহমান চৌধুরী মনে করেন, “সাংবাদিকতাকে রক্ষায় এখন সব সাংবাদিককে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।”

আইনে বলা হয়েছে, তথ্য অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ এর বিধানাবলি কার্যকর থাকবে। বুলবুল বলেন, “আমাদের তথ্য অধিকার আইনের সাথে সবচেয়ে সাংঘর্ষিক ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’। অথচ এই দুটো বিষয় এখানে একত্রে আছে।”

আইনে ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ; মানহানিকর তথ্য প্রকাশ; ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত; আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তি তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে অপরাধে জেল জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য। বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে কোনো বাংলাদেশি এই আইন লঙ্ঘন করলে তাঁর বিচার করা যাবে।

মানবজমিন সম্পাদক বলেন, “এই আইন কার্যকর হওয়ায় সংবাদপত্রের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এবং সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপ বাড়বে।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কামরান রেজা চৌধুরী

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।