ঢাকায় নিখোঁজের দুদিন পর অপহৃত সাংবাদিক সুনামগঞ্জে উদ্ধার
2019.08.06
ঢাকা
ঢাকা থেকে নিখোঁজের দুদিন পর সাংবাদিক মুশফিকুর রহমানকে আহত অবস্থায় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গোবিন্দপুর এলাকার একটি মসজিদের সামনে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
উদ্ধারের পর মুশফিক জানিয়েছেন, চোখে কিছু একটা স্প্রে করে গুলশান থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল। অপহরণকারীরা তাঁকে অনেক মারধর করেছে। একপর্যায়ে গুলি করে হত্যা করার হুমকিও দিয়েছিল।
গত শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন মুশফিক। ওই রাতেই গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন মুশফিকের মামা এজাবুল হক। উদ্ধারের পর মুশফিক বলেছেন, কে বা কারা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
এদিকে ঢাকা থেকে নিখোঁজ দুই সফটওয়্যার প্রকৌশলীরও সন্ধান মিলেছে। তাঁদের একজন আতাউর রহমান রোববার দিবাগত রাতে বাসায় ফিরেছেন। অন্যজন কামরুল হাসানকে গত ১৬ জুলাই বগুড়ায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।
তবে এত দিন কোথায় ছিলেন, কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে কোনো কথা বলেননি ফিরে আসা আতাউর বা তাঁর পরিবার।
এক মাসের ব্যবধানে এই দুই সফটওয়্যার প্রকৌশলী নিখোঁজ হয়েছিলেন। গত ১ এপ্রিল মিরপুর ডিওএইচএসের ১ নম্বর গেট এলাকা থেকে কামরুল হাসান এবং ২ মে তেজগাঁওয়ের গুলশান লিংক রোড থেকে নিখোঁজ হন আতাউর রহমান।
একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, কালো কাচযুক্ত একটি সাদা হাইএস গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আতাউরকে। তবে কামরুলকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে কোনো কিছু তখন জানা যায়নি।
গাড়ি থেকে নামিয়ে দৌড়াতে বলা হয়
মোহনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মুশফিককে মঙ্গলবার ভোরে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গোবিন্দপুর এলাকায় পাওয়ার পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
গোবিন্দপুর এলাকার বাসিন্দা ফুয়াদ মনি বেনারকে জানান, “ভোরে গোবিন্দপুর এলাকার একটি মসজিদের সামনে গিয়ে মুশফিক মুসল্লিদের কাছে তিনি কোথায় আছেন তা জানতে চান।”
“তাঁর পরিচয় পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা মোহনা টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি কুলেন্দু শেখর দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে পুলিশ গিয়ে মুশফিককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়,” বলেন তিনি।
মুঠোফোনে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুশফিক বেনারকে বলেন, সেদিন গুলশান ১ নম্বরে মামার সঙ্গে দেখা করে মিরপুরে ফেরার জন্য একটি বাসে উঠে বুঝতে পারেন ভুল বাসে উঠেছেন। বাসটি থেকে নেমে মহাখালীতে হাঁটার সময় হঠাৎ তাঁর চোখেমুখে পানির মতো কিছু একটা ছিটকে আসে। চোখ জ্বলতে শুরু করে। তেমন কিছু দেখছিলেন না, কিন্তু হেঁটে যাচ্ছিলেন।
বলেন, “একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরে দেখি আমার হাত-পা ও চোখ বাঁধা। প্রথমেই কেউ একজন বলে, তোকে তো মেরে ফেলব। কীভাবে মরতে চাস। গুলি করে মারলে কষ্ট কম হবে তোর। আরেকজন তখন বলে উঠে, না ওকে গলা কেটে মেরে ফেলব। এর পরপর আরেকজন বলে, ওকে মেরে বস্তায় ভরে ইট বেঁধে পানিতে ফেলে দেবো।”
মুশফিক বলেন, “প্রচণ্ড ক্ষুধায় খাবার চাইলে আমাকে কয়েক টুকরো পেয়ারা দেওয়া হয়। আবার কখনো পানি চোখে-মুখে ছিটিয়ে দেয়। একবার তারা এনার্জি ড্রিংক খেতে দেয়।”
তিনি জানান, “কখন দিন হয়েছে, কখন রাত হয়েছে তার কিছুই টের পাইনি।”
মুশফিক জানান, তাঁকে মারধর করা হয়। একবার অপহরণকারীরা তাঁর শেষ ইচ্ছাও জানতে চায়। তখন তিনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা রাজি হয়নি।
তিনি বলেন, “সর্বশেষ ঘুটঘুটে অন্ধকার মতো একটি জায়গায় যখন গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তখন বলা হয়, তুই সোজা দৌড় দিবি। পেছনে ফিরে তাকালেই গুলি করা হবে।”
“এও বলা হয় সূর্য ওঠার আগে কারও সঙ্গে কথা বলবি না। এই অবস্থায় কয়েক কিলোমিটার দৌড়াই। পথে দু-একজনের সঙ্গে দেখা হলেও কথা বলিনি। মনে হচ্ছিল এই বুঝি পেছন থেকে গুলি করবে,” বলেন মুশফিক।
কারা অপহরণ করেছিল, কাউকে সন্দেহ করেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মুশফিক জানান, সম্প্রতি মিরপুরের একটি স্কুল কমিটির সভাপতি হওয়ার পর থেকে তাঁকে নানভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
গত ২১ জুলাই তাঁকে একটি মুঠোফোন নম্বর থেকে ফোন দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। মুঠোফোনের নম্বর উল্লেখ করে তিনি পল্লবী থানায় একটি জিডিও করেছিলেন। ওই নম্বর কার সেটা খুঁজে বের করলেই অপহরণকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান বলেন, “তাঁকে পাওয়া গেছে, আল্লাহর শুকরিয়া।”
তিনি জানান, “থানার একটি দল সুনামগঞ্জে গেছে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের আগে কে বা কারা তাঁকে অপহরণ করেছে সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।”
ফিরে এসে চুপ আতাউর
নিখোঁজের তিন মাস পর রোববার মধ্যরাতে ফিরে আসেন আতাউর। তবে আতাউর বা তার স্ত্রী এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের ২ নম্বর সড়কে তাঁদের নিজেদের ফ্ল্যাটেও তাঁরা নেই। এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। এর ঠিকানাও দেননি স্বজনেরা।
আতাউরের শ্যালক মো. রবিউল ইসলাম মুঠোফোনে বেনারকে বলেন, “আতাউর যে পোশাকে নিখোঁজ হয়েছিলেন, সেই পোশাকেই ফেরত এসেছেন। তাঁর শরীরেও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে তিনি কোথায় ছিলেন, কারা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো কথা হয়নি।”
আতাউরের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনুরোধ করলে তিনি বলেন, “আপনারা বুঝেনই তো। এই পরিস্থিতিতে কেউ কি কথা বলতে চায়? আপনারা আর এই বিষয়টি নিয়ে কিছু বলবেন না। উনাকে ফিরে পেয়েছি, এতেই আমরা খুশি।”
আড়াই মাস পর গ্রেপ্তার কামরুল
কামরুলের বাবা বিমানবাহিনীর সাবেক মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার মো. রুস্তম আলী বেনারকে জানান, নিখোঁজ হওয়ার আড়াই মাস পর তাঁর ছেলেকে গত ১৬ জুলাই বগুড়া থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওইদিন বগুড়া ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাঁকে ফোন দিয়ে কামরুলকে গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়।
বগুড়ার শেরপুর থানায় ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পুলিশের দাবি, বগুড়ায় একটি বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করা অবস্থায় কামরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে রুস্তম আলী জানান, ১ আগস্ট তিনি বগুড়া জেলা কারাগারে দেখা করলে কামরুল তাঁকে জানিয়েছেন, “১ এপ্রিল অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে একটি মাইক্রোবাসে করে তাঁকে একটি সংস্থার কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চার-পাঁচ দিন রাখার পর তাঁকে বগুড়া পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি বগুড়া ডিবি কার্যালয়েই ছিলেন। ১৬ জুলাই তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।”