গুম প্রতিরোধ দিবসে স্বজনদের প্রতিবাদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন 'গুম বলে কিছু নেই'
2023.08.30
ঢাকা
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চলতি মেয়াদ যখন প্রায় শেষের দিকে সে সময় গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ দেখিয়েছে বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি।
বুধবার রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব বড়ো শহর ও কিছু জেলায় গুমের প্রতিবাদ জানিয়ে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মানববন্ধন ও মিছিল করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
দিবসটি উপলক্ষে সকালে রাজধানীর কাকরাইলে ইন্সটিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ মিলনায়তনে স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
মায়ের ডাক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠান শেষে গুমের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যরা সেখান থেকে পদযাত্রা করে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে যোগ দেয়।
মায়ের ডাক আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জাতিসংঘসহ ঢাকাস্থ বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তারা।
সংগঠনটির সদস্য ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা গুমের এসব ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করেন।
এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে সরকার।
গুম বলে কিছু নেই: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার বেনারকে বলেন, “দেখুন, বাংলাদেশে গুম বলে কিছু নেই। যারা গুমের শিকার বলে দাবি করে, তারা মূলত বিভিন্ন অপরাধে নিশ্চিত সাজা হবে জেনেই পালিয়ে যায় এবং কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যে লোকসান করে গা ঢাকা দেয়।”
পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে প্রতি বছর ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্তের জন্য বাংলাদেশকে জাতিসংঘ যে প্রস্তাব দিয়েছে তা গ্রহণ করতে বুধবার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
বুধবার এইচআরডব্লিউ এ সংক্রান্ত বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বলপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনে জাতিসংঘের প্রস্তাব গ্রহণ করা।
গত বছর বাংলাদেশে সফর শেষে জাতিসংঘের তৎকালীন মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও এসব বিষয়ে জবাবদিহিতার অভাব আছে বলে মন্তব্য করেন।
তিনি এসব অভিযোগের বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বলপূর্বক গুমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ কর্তৃপক্ষ বারবার অস্বীকার করে—নিখোঁজ ব্যক্তিরা আত্মগোপনে রয়েছে এমন প্রহসনমূলক দাবির পুনরাবৃত্তি করেই চলছে। বাংলাদেশি মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ছয় শতাধিক ব্যক্তিকে জোরপূর্বক গুম করেছে।”
“যদিও কিছু লোককে পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, আদালতে হাজির করা হয়েছিল বা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে বলে দাবি করা হয়। তবে এখনো প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন,” বলা হয় বিবৃতিতে।
এইচআরডব্লিউ-এর সিনিয়র এশিয়া বিষয়ক গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, “বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বলপূর্বক গুমের ঘটনা অস্বীকার করে কাউকে বোকা বানাচ্ছে না, বরং নিজেদের স্বজন ফিরে পেতে ব্যাকুল মানুষদের কষ্ট দীর্ঘায়িত করছে।”
ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক এবং কর্তৃপক্ষ বারবার কূটনীতিকদের গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে বাধা দিয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ বারবার দাতা দেশ, জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজের আহ্বান উপেক্ষা করেছে।”
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেন, “কোন সংস্থা কী বলল সেটা কোনো বিষয় নয়। তারা বলুক...আমাদের সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনাই তদন্ত করে।”
নিখোঁজদের ফিরে পেতে স্বজনের কান্না
বুধবার গুম প্রতিরোধ দিবসে আয়োজিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে পিতা-মাতা, সন্তানরা তাদের স্বজনের সন্ধান চাইতে গিয়ে আবেগ প্রবণ হন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মায়ের ডাক আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কথা বলেন রাজধানীর বংশাল থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনের ১২ বছর বয়সী কন্যা আদিবা ইসলাম হৃদি। ২০১৩ সালে ডিসেম্বর মাসে হৃদির বাবা যখন নিখোঁজ হন, সে সময় তার বয়স ছিল দুই বছর।
কাঁদতে কাঁদতে হৃদি বলে, “১০ বছরে আমি আমার বাবাকে দেখিনি। আমি বাবার ছবি নিয়ে গুম প্রতিরোধ দিবস পালন করতে চাই না। বাবার হাত ধরে বাবা দিবস পালন করতে চাই।”
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ২০১২ সালের আগস্ট মাসে ছাত্রদল নেতা ফিরোজ খানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর স্ত্রী আমেনা আকতার বলেন, “১১ বছর ধরে স্বামীর সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। কাপড় সেলাই করে সংসার চালাই। আমার স্বামীকে কী করেছেন, তার জবাব সরকারকে দিতে হবে।”
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মফিজুল ইসলাম রাশেদকে ২০১৩ সালের এপ্রিলে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাশেদের ছেলে সায়েদুল ইসলাম রিমন বলেন, “বাবার খোঁজ পেতে আমার মা আইন ও সালিশ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এরপর থেকে ছোট ভাইকে নিয়ে কী রকম মানবেতর জীবন যাপন করছি—তা বলে বোঝানো সম্ভব না।”
“এই সরকারকে অনেক বলেছি, তারা আমাদের কথা শোনে না। শুনলেও আমলে নেয় না। তারা এটা আমলে নেবেও না। কারণ যে অপরাধ তারা নিজেরা করেছে তার বিচার তারা কীভাবে করবে! নিজের গলায় তো নিজে ফাঁসি পরাতে পারবে না তারা,” বলেন তিনি।
গুমের ঘটনায় সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আপনারা আর চুপ থাকবেন না। আপনার আজকের নীরবতা কালকে আপনার সন্তানের কান্না হবে।”
শাহবাগে ‘মায়ের কান্না’র মানববন্ধন
এদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় ১৯৭৭ সালে সেনা ও বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যের ফাঁসি ও কারাদণ্ড হয়। চাকরিচ্যুত হন অনেকেই। সেসব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে ‘মায়ের কান্না’ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনটিকে ‘মায়ের ডাক’ এর কাউন্টার সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৯৭৭ সালের সেইসব ঘটনার বিচার চেয়ে বুধবার এই সংগঠনটি মানববন্ধন করে ঢাকার শাহবাগে।