বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু এক ‘নীরব মহামারি’

শরীফ খিয়াম
2018.08.03
ঢাকা
180803-BD-swim-620.jpg ঢাকার নিকটবর্তী একটি পুকুরে কিশোরীদের সাঁতার। ১৪ জুলাই ২০১৭।
AP

বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমছেই না। নদীমাতৃক দেশে এটি ‘নীরব মহামারি’ রূপ ধারণ করে থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি বা বেসরকারি যেসব উদ্যোগ রয়েছে তা এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে যথেষ্ট নয়।

পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে ২০১৫ সালের এপ্রিলে স্কুল-কলেজসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সাঁতার প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় সরকার। একইসঙ্গে সব জলাশয়কে স্বাস্থ্যসম্মত ও সাঁতার উপযোগী করে তুলতে বলা হয়েছিল।

সরকারি সেই উদ্যোগ পরিপত্র জারির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে এ জন্য স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার অবকাঠামো, সামাজিক পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তার অভাবকেই দায়ী করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “বাস্তবতা হলো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যথেষ্ট খেলার মাঠই নেই, যা ন্যুনতম ৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে থাকা উচিত। সেখানে পুকুর বা জলাশয়ের অভাব আরো বেশি।”

তাছাড়া দেশের সামাজিক অবস্থায় ছেলেদের ‍উন্মুক্ত পরিবেশে সাঁতার শেখানো গেলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয় জানিয়ে নাহিদ বলেন, “এজন্য আমরা সময় নিচ্ছি।”

“সব মিলিয়ে এমন আয়োজন এক বিরাট কঠিন কাজ। তবে ভবিষ্যতে আমরা এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চাই,” যোগ করেন তিনি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “সন্তানকে সাঁতার শেখাতে ব্যক্তি উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই।”

গত ১৪ জুলাই কক্সবাজারে মাতামুহুরী নদীতে ডুবে পাঁচজন স্কুল ছাত্র মারা যায়। এর মধ্যে নিহত এমশান ও মেহবার দুই ভাই।

তাদের বাবা আনোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “আমার দুই ছেলে সাঁতার না জানায় নদীতে ডুবে মারা গেছে। তারা বলেছিল সাঁতার শেখাতে। সেটা করলে আজ হয়ত আমার সন্তানেরা বেঁচে থাকত।”

একই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেঘনা নদীতে গোসল করতে নেমে ডুবে মারা যায় নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী তানজিবা বিনতে তানভীর ও তার বন্ধু ইশরাকুল মেহরাব।

প্রতিদিন ৫০ শিশুর মৃত্যু

বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশে পানিতে ডুবে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজারের বয়স অনুর্ধ ১৮। অর্থাৎ দৈনিক ৫০ জনেরও বেশি শিশু এই নীরব মহামারির শিকার।

সমীক্ষায় আরো বলা হয়, এসব মৃত্যুর ৮০ ভাগই ঘটছে বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে থাকা জলাধার অর্থ্যাৎ পুকুর, খাল, বিল, নদী ইত্যাদিতে ডুবে।

তবে চলতি বছরের মার্চে ঢাকায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি) এক সেমিনারে জানায়, পানিতে ডোবার ঘটনার দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে পুকুরে এবং বাড়ির ১০০ মিটারের মধ্যে।

তাদের মতে বর্ষাকালে, জুন থেকে অক্টোবর মাসে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। গ্রামাঞ্চলে সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুইটার মধ্যে এটি বেশি ঘটে; কারণ বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা তখন গৃহস্থলীর কাজে ব্যস্ত থাকে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা সুইমসেইফ বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ দেশে গত দশকের চেয়ে সার্বিক শিশুমৃত্যুর হার কমলেও পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল-এনসিডিসি এর লাইন ডিরেক্টর ডা. নুর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে করণীয় নির্ধারণে একটি গাইড লাইন তৈরির কাজ চলছে।”

ডুবে মৃত্যুর তিন কারণ

বিশেষজ্ঞরা পানিতে ডুবে মৃত্যুর তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন; সাঁতার না জানা, কম নজরদারি এবং ডুবে গেলে করণীয় সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব।

সিআইপিআরবি’র পরিচালক ও শিশুদের ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গঠিত দলের প্রধান ডা. আমিনুর রহমান বেনারকে বলেন, “পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা এখনও এক ‘নীরব মহামারি’।”

সারাদেশে সাত লাখেরও বেশি শিশুদের সাঁতারের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। এ মহামারি ঠেকাতে প্রতিরোধ ও প্রতিকার দুই দিকেই নজরের পরামর্শ দেন আমিনুর।

“শিশুদের অবশ্যই সাঁতার শেখাতে হবে। পাশাপাশি কেউ পানিতে ডুবে গেলে করণীয়, প্রাথমিক চিকিৎসা, হাসপাতালে নেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় জানতে ও শেখাতে কমিউনিটিভিত্তিক সচেতনতা কর্মসূচি থাকতে হবে,” বলেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ডা. নুর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “সরকারের মাল্টি সেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যানের আলোকে সব অংশীজন নিয়ে কমিটি করা হবে। তারা নিজ নিজ সেক্টরে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেবে।”

পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক কমিটি করা হয়েছে বলেও জানিয়ে এই কর্মকর্তা আরো বলেন, “কমিটি শিগগির সভা করে করণীয় ঠিক করবে।”

সাঁতার পাঠ্য করা জটিল

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু কমাতে ডা. আমিনুরের অভিমত, “সাঁতার শেখার বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।” তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক এনায়েত হোসেন বেনারকে বলেন, “পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বেশ জটিল।”

“অনেক অগ্রাধিকারমূলক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন সাঁতার যোগ করলে পাঠক্রম আরও বড় হয়ে যাবে,” বলেন তিনি। তবে তাঁর দাবি, সরকার পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।

যদিও এ ব্যাপারে সিআইপিআরবি’র আরেক পরিচালক সেলিম মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “ডুবে মৃত্যুর হার প্রতিরোধে সরকার গত কয়েক বছরে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এর ভয়াবহতা যত বেশি সেই হিসেবে এসব উদ্যোগ অত্যন্ত সামান্য।”

প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে শিশুমৃত্যু

সুইমসেফের তথ্যমতে, ১-৪ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কারণ হিসেবে বলা হয়, মা বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকায় শিশুর প্রতি অনেক সময় খেয়াল করতে পারেন না।

এছাড়াও বালতি বা অন্য কিছুতে রাখা সামান্য পানিও যে শিশুমৃত্যুর কারণ হতে পারে সে ব্যাপারটিও অনেকের মাথায় থাকে না।

গবেষণা মতে, এশিয়ায় প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একজন শিশুর ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তবে সংস্থাটি মনে করে বাস্তবচিত্র আরও ভয়াবহ।

পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাগুলো হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছায় না বলে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া খুব কঠিন, বলেছে তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।