বৈদেশিক মুদ্রার বড় কারসাজি : ব্যাংকের ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক
2024.03.27
ঢাকা

অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা কেনা-বেচার অভিযোগে চারটি ব্যাংক ও দুটি মানি এক্সচেঞ্জ হাউসের মোট ২১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছেন।
আসামিদের সবাই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত। দুদক বলছে, তাদের এই জালিয়াতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থিতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
বুধবার দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন। দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সচিব জানান, আসামিদের ১৯ জনই চারটি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাকি দুজন দুটি মানি এক্সচেঞ্জ হাউসে কর্মরত।
মামলার একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে।
ভুয়া ভাউচারে ডলার কিনতেন তারা
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে আসামিরা ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে মার্কিন ডলার ও বৈদেশিক মুদ্রা কিনতেন। পরবর্তীতে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে আসছেন।
দুদকের মামলার আসামিরা হলেন; রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ও বুথ ইনচার্জ আনোয়ার পারভেজ, প্রিন্সিপাল অফিসার শামীম আহমেদ, মো. আশিকুজ্জামান, সিনিয়র অফিসার মো. সুরুজ জামাল, অমিত চন্দ্র দে, মো. মানিক মিয়া, সাদিক ইকবাল, মো. সুজন আলী, মো. সোহরাব উদ্দিন খান, মো. শরীফুল ইসলাম ও মো. হুমায়ুন কবির।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সবুজ মীর, খান আশিকুর রহমান, এবিএম সাজ্জাদ, অফিসার সামিউল ইসলাম ও সাপোর্টিং স্টাফ মো. মোশারফ হোসেনের নাম রয়েছে এজাহারে।
অন্য আসামিরা হলেন; বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের অফিসার মো. আবু তারেক প্রধান, অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মো. আব্দুর রাজ্জাক, এভিয়া মানি এক্সচেঞ্জারের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার মো. আসাদুল হোসেন ও ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জের পরিচালক কে এম কবির আহমেদ।
এজাহারে বলা হয়, অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যাংক ও নিবন্ধিত মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হয়েও বেআইনিভাবে বিদেশি মুদ্রা কিনে ব্যক্তিগত লাভের জন্য খোলাবাজারে বিক্রি করায় আসামিরা দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যে দণ্ডবিধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা আইন, ১৯৪৭ এর অধীনে অপরাধ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদি নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট শাহজালাল বিমানবন্দরে অভিযান চালিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে ভয়াবহ কারসাজির তথ্য পেয়েছে।”
পরবর্তীতে হোতাদের চিহ্নিত করতে দুদক চার সদস্যের টিম গঠন করে জানিয়ে তিনি বলেন, “বিমানবন্দরের ভেতরে থাকা সাতটি ব্যাংক ও দুটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছ থেকে ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ নেওয়া হয়।”
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, বিদেশ থেকে প্রতিদিন আসা যাত্রীদের কাছ থেকে শত কোটি টাকার বেশি মূল্যের ডলার ও বৈদেশিক মুদ্রা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করছে চক্রটি।
বৈদেশিক মুদ্রা যেভাবে আত্মসাৎ
দুদকের সদ্য বিদায়ী সচিব মাহবুব হোসেন গত ৬ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীদের শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে না দেখিয়ে বিদেশে পাচার করার প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা।
তিনি জানান, বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানে একটি চক্র গড়ে তুলেছেন।
তিনি বলেন, এই চক্রের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত প্রতিদিন প্রায় ১০০ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বুধবার নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “জাল ভাউচারে যাত্রীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে পরে তা খোলাবাজারে ছাড়তো এই চক্রের সদস্যরা।”
তিনি জানান, বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিরা তাদের সঙ্গে আনা বৈদেশিক মুদ্রা বিমানবন্দরে থাকা ব্যাংকের বুথ ও মানি এক্সচেঞ্জারে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে থাকেন।
আইন অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট দেখে এবং ভাউচার বা এনক্যাশমেন্ট স্লিপ দিয়ে, লেজার-সিস্টেমে এন্ট্রি করে যথাযথভাবে হিসাব রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ব্যাংকের অধিকাংশ বুথ ও মানি এক্সচেঞ্জ বুথে দায়িত্বরত এসব অসাধু কর্মকর্তারা তা মানেন না।
“তাদের মদদদাতা ও সহযোগীদের বিষয়ে কমিশনের নির্দেশে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কমিশন আইন ও বিধি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে,” বলেন মাহবুব হোসেন।
তিনি আরও বলেন, অসাধু কর্মকর্তারা ব্যাংকের টাকা ব্যবহার করে ব্যাংকিং চ্যানেলে সংগৃহীত না দেখিয়ে নিজেরাই ডলার কিনে মার্কেটে বিক্রি করে দেন, যা পরবর্তীতে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়।
দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানিয়েছেন, এই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন এবং কী পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন তা খতিয়ে দেখা হবে। এই ২১ জনের পেছনে কারা আছে তাও খুঁজে বের করা হবে।
দুদকের এই তৎপরতাকে স্বাগত জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বেনারকে বলেন, “দেশে চলমান ডলার সংকটের মধ্যে এই অভিযান ও মামলার ঘটনা খুবই ইতিবাচক। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে বিমানবন্দরে নজরদারি বাড়াতে হবে।”