বিশ্বজুড়ে আলোচিত তুরস্কের বিধ্বংসী ড্রোন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে
2024.03.29
ঢাকা
তুরস্কের অত্যাধুনিক ‘বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন’ যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে।
গত বছরের ডিসেম্বরে তুরস্ক থেকে অত্যাধুনিক এই ড্রোন পেয়েছে বাংলাদেশ, যা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি।
জানতে চাইলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল আবু হায়দার মোহাম্মদ রাসেলুজ্জামান বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকার প্যারেড স্কয়ারে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপি সামরিক অস্ত্র প্রদর্শনীতে এই ড্রোনের একটি ডামি প্রদর্শন করা হয়। ৩০ মার্চ প্রদর্শনী শেষ হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী শুক্রবার বেনারকে বলেন, বর্তমান বিশ্বে সামরিক বাহিনীতে এবং যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহার বেড়েছে। এর কারণ, এগুলোর খরচ তুলনামূলক কম এবং এগুলো দিয়ে নির্ভুলভাবে নিশানায় আক্রমণ করা যায়। এ ছাড়া, ড্রোন উড়িয়ে অনেক দূর থেকে ‘রিয়েল টাইম’ তথ্য পাওয়া যায়, ছবি ও ভিডিও নেওয়া যায়।
“তুরস্কের বায়রাকতার ড্রোন যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা আরেক ধাপ উন্নীত হলো। বাংলাদেশ ড্রোন যুগে প্রবেশ করল। এই ড্রোন অত্যন্ত কার্যকর এবং শত্রুকে ঘায়েল করতে সক্ষম,” যোগ করেন তিনি।
ইশফাক বলেন, “ইউক্রেন বায়রাকতার ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার শক্তিশালী আকাশ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেদ করে আক্রমণ করতে পেরেছে। ২০২০ সালে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে আজারবাইজান এই ড্রোন ব্যবহার করেছে। আর্মেনিয়ার পরাজয়ের কারণও ছিল এই ড্রোনের ব্যবহার।”
গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের পটভূমিতে অনেকেই নজর রাখছেন কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণের দেশ তুরস্ক ও তাদের তৈরি করা ড্রোনের দিকে। শুধু ইউক্রেন নয়, বস্তুতঃ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা সংঘাতেই তুরস্কের তৈরি ড্রোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
একই বছরের ১০ অক্টোবর বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘নাগোর্নো-কারাবাখ: আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যেকার যুদ্ধের চেহারা যেভাবে বদলে দিয়েছে ড্রোন’। এতে বলা হয়, লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে তুরস্কের তৈরি ড্রোন।
এই ড্রোনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সামরিক নজরদারিতে আরও সমৃদ্ধ হলো মন্তব্য করে ইশফাক ইলাহী বলেন, “মিয়ানমার সীমান্তে নজর রাখতে অনেক মানুষ নানাভাবে যুক্ত করতে হতো। এতে শ্রম, প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় হতো। তাছাড়া, ঝুঁকিও আছে। এই ড্রোন উড়িয়ে বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে থেকেই ওপারে কী হচ্ছে সেই ‘রিয়েলটাইম তথ্য’ পাওয়া যাবে। মিয়ানমার সীমান্তে এটি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।”
তিনি বলেন, “সামরিক সরঞ্জামের জন্য বাংলাদেশ মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীল। তুরস্ক থেকে ড্রোন কেনায় অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের উৎস বহুমুখীকরণ হলো। ”
গত ৩১ জুলাই ২০২২ বিবিসি বাংলার প্রতিবেদেন বলা হয়, তুরস্কের কাছ থেকে বাংলাদেশ কত টাকায় ড্রোন বাংলাদেশ কিনতে যাচ্ছে, তা জানা যায়নি। তবে একেকটি ড্রোন অন্তত ১০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যে তুরস্ক বিক্রি করে থাকে। যদিও ইউক্রেনের কাছে একেকটি বিক্রি করা হয়েছে সাত লাখ মার্কিন ডলারে। এই দামে কেনা হলে বাংলাদেশের জন্য প্রতিটি ড্রোনের দাম পড়বে কম বেশি ১০ কোটি টাকা।
যেভাবে আলোচনায় বায়রাকতার ড্রোন
১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। মূল ভূ-খণ্ড থেকে আলাদা নগরনো কারাবাখ অঞ্চলটি ১৯৯২ সালে সামরিক শক্তি দিয়ে দখল করে নেয় আর্মেনিয়া, প্রতিষ্ঠা করে বিদ্রোহী স্বশাসিত সরকার।
ইসরায়েল ছাড়াও আর্মেনিয়ার চির প্রতিপক্ষ এবং আজারবাইজানের বন্ধুরাষ্ট্র তুরস্কের সহায়তায় ২০২০ সালে নগরনো কারাবাখ আক্রমণ করে আজারবাইজান। সেখানে ব্যবহৃত হয় বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন। এই ড্রোনের মাধ্যমে রাশিয়ার অস্ত্রে সজ্জিত আর্মেনিয়ার সেনারা পর্যুদস্ত হয়। প্রায় দেড় মাসের যুদ্ধে আজারবাইজানের কাছে আত্মসমর্পণ করে আর্মেনিয়া।
ইউক্রেন ২০২২ সালের যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন ব্যবহার করে।
বায়রাকতার টিবি২: দাম ও ক্ষমতা
মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর) এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি বায়রাকতার টিবি২ সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে ছয়টি ড্রোন, দুটি স্থল নিয়ন্ত্রণ স্টেশন এবং প্রয়োজনীয় সহায়ক যন্ত্রপাতি। তুরস্ক এই ড্রোন লিবিয়া ও সিরিয়ায় রাশিয়ান সামরিক যানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। ড্রোনটি বিভিন্ন যুদ্ধে সফলভাবে সামরিক যান ধ্বংস করা ছাড়াও চলমান আকাশ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে।
বাইকারটেক ডটকমের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি হচ্ছে এমন এক ধরনের যুদ্ধাস্ত্র যা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং হামলায় অংশ নিতে পারে। ড্রোনটি ঘণ্টায় ১২৯ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ২২২ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে। বেজ স্টেশন থেকে তিনশো কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ড্রোনটি চালানো যায়। এর ভেতরে একমন কিছু সেন্সর রয়েছে, যার ফলে জিপিএসের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে ন্যাভিগেশন করতে পারে। সর্বোচ্চ সাতশো কেজি ওজন নিয়ে ড্রোনটি উড়তে পারে। মোট জ্বালানি ধরে ৩০০ লিটার। বায়রাক্টার টিবি-টু ১৮ হাজার ফিট উচ্চতায় থেকে কার্যক্রম চালাতে পারে। তবে আকাশে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ফিট পর্যন্ত উড়তে এবং সর্বোচ্চ ২৭ ঘণ্টা তিন মিনিট ওড়ার রেকর্ড রয়েছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ শুক্রবার বেনারকে বলেন, প্রথাগত অস্ত্র যেমন ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাংক-এগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একটি ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে কমপক্ষে পাঁচ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। এর বিপরীতে একটি ড্রোন অনেক কমে পাওয়া যায়। অনেক সময় এক লাখ ডলারেও পাওয়া যায়।
রশীদ বলেন, “বায়রাকতার ড্রোনটির বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে। এটি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে সমৃদ্ধ করেছে এবং সার্বিকভাবে আমাদের আত্মরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে।”
তিনি বলেন, “কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রই আমাদেরকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে না। তারা আক্রমণ করবে বলেও মনে হয় না। তবে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ড্রোন প্রযুক্তি আমাদের প্রতিরক্ষায় ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে।”
ভবিষ্যতে বাংলাদেশও বৈশ্বিক মানের অত্যাধুনিক ড্রোন প্রস্তুত করবে বলে এ সময় আশাবাদ ব্যাক্ত করেন তিনি।