কক্সবাজার থেকে স্মরণকালের সর্বোচ্চ, প্রায় ১৮ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার

সুনীল বড়ুয়া
2021.02.09
কক্সবাজার
কক্সবাজার থেকে স্মরণকালের সর্বোচ্চ, প্রায় ১৮ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার কক্সবাজারের চৌফলদণ্ডীর বাঁকখালী নদীতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধারের পাশাপাশি দুইজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা নৌকার দুই পাশে বসা, একজনের পরনে গোলাপি শার্ট, অন্যজন শার্ট ছাড়া। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ইয়াবা বড়ি উদ্ধার হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ১৮ লাখ পিস। এ সময় দুজনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা ছাড়াও একজনের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নগদ এক কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার টাকা উদ্ধার করেছে পুলিশ। 

“আমার জানামতে, এটিই দেশে উদ্ধার হওয়া ইয়াবার সবচেয়ে বড়ো চালান,” জানিয়ে কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বেনারকে বলেন, “ট্রলারে সাত বস্তায় ১৪ লাখ ইয়াবা পাওয়া যায়, পরে একটি বাড়ি থেকে আরও আরো ৩ লাখ ৭৫ হাজার পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়।” 

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো একদিনে এর চেয়ে বেশিসংখ্যক ইয়াবা উদ্ধার হওয়ার তথ্য দিতে পারেনি।

উল্লেখ্য, কক্সবাজার ইয়াবা পাচারের মূল উৎস, যেখানে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসে এবং তা বাংলাদেশের চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। 

পুলিশ জানায়, জেলা সদরের চৌফলদণ্ডী সেতুর নিচে বাঁকখালী নদী থেকে মঙ্গলবার ১৪ লাখ ইয়াবা বড়িসহ দুই ব্যক্তিকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এদের একজন জহিরুল ইসলাম ফারুকের (৪৮) চাচা শ্বশুর ছৈয়দ আলমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পরে আরও ৩ লাখ ৭৫ হাজার পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়। 

পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান জানান, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ইনানী থেকে ওই মাছ ধরা ট্রলারটি পুলিশ নজরদারি শুরু করে। চৌফলদণ্ডীতে ভিড়ানোর পর ট্রলারটি পুলিশ তল্লাশি করে। 

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইয়াবার এই চালানের সাথে দুইজনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। এদের মধ্যে জহিরুল ইসলাম ফারুক ইয়াবার বড়ো ব্যবসায়ী। জহিরুল কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে। অপরজন একই এলাকার মোজাফফার আহমেদের ছেলে মো. বাবুল (৫০)। 

ইয়াবা উদ্ধারের পর ফারুককে নিয়ে তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে নগদ এক কোটি ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। 

এর আগে গত বছরের ২৪ আগস্ট র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) কক্সবাজারে বঙ্গোপসাগর থেকে ১৩ লাখ পিস এবং ২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমা থেকে নৌ বাহিনী ১৪ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছিল।

এতদিন এটাই ছিল একদিনে সর্বোচ্চসংখ্যক ইয়াবা উদ্ধারের রেকর্ড। 

“ইয়াবা কারবারিরা নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। স্থলভাগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় থাকায় পাচারকারীরা নৌ পথকে ইয়াবা পাচারের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করছে,” জানান হাসানুজ্জামান। 

কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সোমেন মণ্ডল বেনারকে বলেন, ২০১৯ সালে মাদকের বিরুদ্ধে এক হাজার ৭৬০টি আর ২০২০ সালে এক হাজার ৯০৭টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। 

তিনি জানান, গত দুই বছরে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মোট ৭৭৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় ৭৩জন পলাতকসহ মোট আসামির সংখ্যা ৯২০ জন। 

সোমেন মণ্ডল বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে, মামলার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তবুও মাদক পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। 

তাঁর মতে, উপযুক্ত ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার কারণে মাদক ব্যবসা থামছে না। 

“আরেকটি কারণ হচ্ছে, রোহিঙ্গারাও এখন মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে। ফলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ইয়াবাসহ মাদক চোরাচালানের নিরাপদ স্থান হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্যাম্পগুলোর অবস্থানগত নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেখানে সব সময় অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয় না,” জানান এই কর্মকর্তা। 

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ জানান, চলতি বছরের শুরু থেকে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি এ পর্যন্ত প্রায় সোয়া ১২ কোটি টাকা মূল্যের ৪ লাখ ৬২ হাজার ৩৮২টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে। 

টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক রোহিঙ্গা নিহত 

মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসার সময় কক্সবাজারের টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদীর তীরে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। 

মঙ্গলবার ভোরে বিজিবির সঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তি রোহিঙ্গা নিশ্চিত হওয়া গেলেও তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছে বিজিবি। 

টেকনাফ–২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান জানান, ‘মিয়ানমার জলসীমা থেকে নাফ নদ পার হয়ে কতিপয় ব্যক্তি নৌকাযোগে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের দিকে আসছিল। বিজিবি’র টহল দল তাদের চ্যালেঞ্জ করলে সশস্ত্র ইয়াবা পাচারকারীরা বিজিবি সদস্যদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। আত্মরক্ষার্থে বিজিবি সদস্যরাও গুলিবর্ষণ করে। 

তিনি জানান, এক পর্যায়ে দুইজনের মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে পড়ে যায় এবং অপরজন সাঁতার কেটে পালিয়ে যায়। পরে নৌকাটি তল্লাশি করে ৫২ হাজার পিস ইয়াবা ও একটি বন্দুক পাওয়া যায়। 

বন্দুকযুদ্ধে থামছে না ইয়াবা

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। এরপর কয়েকমাস বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বন্ধ থাকলেও গত ডিসেম্বর থেকে বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত ছয়জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। 

এর আগে সোমবার বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন দুই রোহিঙ্গা। তাঁদের কাছ থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা ও দুটি দেশি তৈরি বন্দুক উদ্ধারের কথা জানায় বিজিবি। 

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযান জোরদার করে। কিন্তু মাদকের গডফাদারেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে—এমন অভিযোগ অনেকেরই। 

সাহিত্যিক বিশ্বজিৎ সেন বাঞ্চু বেনারকে বলেন, “মাদক পাচার রোধে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কঠোর অবস্থান দেখছি। অনেকেই বন্দুকযুদ্ধে মারাও যাচ্ছে। কিন্তু যারা মারা যাচ্ছে বেশিরভাগই বহনকারী, বড়ো অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা না গেলে মাদক বন্ধ করা যাবে না।” 

“ইয়াবার প্রধান উৎস মিয়ানমার। টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা আমাদের দেশে ঢুকছে,” জানিয়ে কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা চাই, ইয়াবার গডফাদারদের মূলোৎপাটন করা হোক।” 

তবে মাদক ব্যবসায়ীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের শেকড় উপড়ে ফেলা হবে বলে জানান পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান। 

তিনি বলেন, “কোন এলাকায় কারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, কারা এদের সহযোগিতা করছে, নেপথ্যে কারা রয়েছে—তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ইতিমধ্যে অনেক মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদারের নাম আমাদের হাতে এসেছে।” 

সেন্টমার্টিনে পাঁচ রোহিঙ্গা আটক

মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আসার খবর পেয়ে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি সাগরে অভিযান চালিয়ে পাঁচ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক প্রেস বিফ্রিংয়ে এ কথা জানান সেন্টমার্টিন কোস্ট গার্ড স্টেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার আরিফুজ্জামান। 

তিনি জানান, “মিয়ানমার থেকে কয়েকজন মাদক কারবারি নৌকাযোগে বাংলাদেশ সীমানায় আসছিল। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক হলে কোস্ট গার্ড সদস্যরা সেটিকে ধাওয়া করে আটক করে। পরে নৌকাটিতে তল্লাশি চালিয়ে বস্তার ভেতর থেকে দুইশ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। এ সময় পাচারের ব্যবহৃত নৌকাসহ ওই পাঁচজন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। 

তাদের টেকনাফ মডেল থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। আটক রোহিঙ্গারা হচ্ছেন; মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মুহাম্মদ সাদেক, মোহাম্মদ আইয়ুব, মো. ইউনুছ, নুর কবির ও মো. সাদেক। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন টেকনাফ থেকে আব্দুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।