কক্সবাজারে এক মঞ্চে সেনা ও পুলিশ প্রধান: বললেন সিনহা হত্যার দায় ব্যক্তির

সুনীল বড়ুয়া ও কামরান রেজা চৌধুরী
2020.08.05
কক্সবাজার ও ঢাকা
200805-BD-army-police-chiefs_1000.jpg কক্সবাজারের টেকনাফের শামলাপুরে মেজর সিনহা হত্যার ঘটনাস্থলে এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ (বামে) ও পুলিশের আইজিপি বেনজির আহমেদ। ৫ আগস্ট ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার দায়দায়িত্ব পুলিশ বাহিনী নেবে না। এই দায় যারা তাঁকে হত্যা করেছে তাঁদের ওপর বর্তায়।

বুধবার কক্সবাজারে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়।

‘সন্তান হত্যার বিচার হবে’—মেজর সিনহার মাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোনে এমন আশ্বাস দেওয়ার একদিন পর ঘটনাস্থল টেকনাফ পরিদর্শন করেন দুই বাহিনী প্রধান। তাঁরা সাংবাদিকদের কাছে তাঁদের অবস্থান পরিস্কার করেন।

তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মেজর সিনহা হত্যার দায় প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুলিশ অস্বীকার করতে পারে না।

‘একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা’

টেকনাফের বাহারছড়ার শামলাপুরের যে স্থানে মেজর সিনহাকে হত্যা করা হয় সেই স্থান পরিদর্শন করতে বুধবার কক্সবাজার যান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ ও বেনজির আহমেদ।

পরিদর্শনের আগে কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর একটি রেস্ট হাউসে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন এ দুই বাহিনী প্রধান।

“অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহতের ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী খুবই মর্মাহত। পুলিশ বাহিনীও মর্মাহত,” মন্তব্য করে সেনাপ্রধান বলেন, “তবে এ ঘটনাকে আমরা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখতে চাই।”

ঘটনা তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিন যৌথ কমিটি কাজ শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তদন্ত দলের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। পুলিশ বাহিনীরও আস্থা আছে।”

তদন্ত দল যাদের দোষী সাব্যস্ত করবে তাঁরা তাঁদের দোষের প্রায়শ্চিত্ত করবে। জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁদের সহযোগিতাও করবে না, বিপক্ষেও যাবে না।”

“পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে একে অপরের প্রতি যে আস্থা অনেক বছর ধরে তৈরি হয়েছে, এটা অটুট থাকবে,” বলেন জেনারেল আজিজ।

“আমরাও এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখছি,” মন্তব্য করে একই সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজির আহমদ বলেন, “যে ঘটনাটি ঘটেছে এটার কারণে পারস্পরিক সর্ম্পকের কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে বলে আমরা মনে করি না।”

মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে “অনেকে উস্কানিমূলক অনেক কথাবার্তাও বলছেন,” মন্তব্য করে আইজিপি বলেন, “এই সমস্ত উস্কানি দিয়ে তাঁরা সফল হতে পারবেন না।”

তিনি বলেন, “তদন্ত কমিটি যাদের দোষী সাব্যস্ত করবে, তারা যে পরামর্শ দেবে সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “সেনাপ্রধান ও আইজিপির কথা সহজভাবে বলতে গেলে দাঁড়ায়, মেজর সিনহা হত্যার দায় ব্যক্তি এসআই লিয়াকত ও টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যের। কিন্তু আমি তা মনে করি না। প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুলিশ এই দায় এড়াতে পারে না।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাপ্রধান ও আইজিপি যৌথ সম্মেলন করেছেন এমন ঘটনা বিরল। তাঁরা এই সংবাদ সম্মেলন করেছেন কারণ মেজর সিনহা হত্যাকে কেন্দ্র করে দুই বাহিনী এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে বলে মনে হয়। এই যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এর সমাপ্তি হলো।”

নূর খান বলেন, “শুধু এই হত্যাকাণ্ড নয়, ওই অঞ্চলে যেসকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে না কি প্রতিষ্ঠানের নির্দেশে হয়েছে তা তদন্ত করে দেখা ‍উচিত।”

তিনি বলেন, ২০১৮ সালের মে মাস থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় দুইশ মানুষকে কক্সবাজারে ‘ক্রসফায়ার’ এর নামে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি ইউটিউ চ্যানেলের জন্য ভিডিও শুটিং করতে টেকনাফ গিয়েছিলেন মেজর সিনহা। ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার ফেরার পথে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর সাবেক এই মেজর।

পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পুলিশের তল্লাশি কাজে সহায়তা না করে মেজর সিনহা পিস্তল বের করে গুলি চালাতে চেয়েছিলেন। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায় বলে তাঁদের দাবি।

তবে ঘটনার পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, গাড়ি থেকে হাত উপরে তুলে নামেন মেজর সিনহা। তারপরও তাঁকে গুলি করেন এসআই লিয়াকত।

বোনের হত্যা মামলা দায়ের

পুলিশের গুলিতে সাবেক মেজর সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যা হিসাবে বর্ণনা করে বুধবার কক্সবাজারের আদালতে নয় পুলিশ সদস্যর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস।

এ মামলার প্রধান আইনজীবী মো. মোস্তফা বেনারকে বলেন, মামলায় শামলাপুর বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই মো. লিয়াকতকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে। দুই নম্বর আসামী করা হয়েছে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে।

মামলার বাদি শারমিন বেনারকে বলেন, “আমরা পরিদর্শক লিয়াকত এবং টেকনাফ থানার ওসিসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমরা চেয়েছিলাম মামলাটি র‌্যাবকে তদন্ত দেওয়া হোক, আদালত তা মঞ্জুর করেছেন। আশা করছি আমরা ন্যায় বিচার পাব।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে জানান, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

ক্রসফায়ার বন্ধের দাবি

ক্রসফায়ার বন্ধের দাবি জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, অপরাধ দমনে এই প্রক্রিয়ায় ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ গড়ে ওঠে। এরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য, মুনাফা লাভের জন্য ক্রসফায়ার ব্যবহার করে থাকে।

বুধবার অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা ঢাকার রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, সিনহা মো. রাশেদ খানকে পুলিশের হেফাজতে হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ (আসক) বেশ কয়েকটি সংগঠন। বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো পৃথক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়েছে।

টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “একে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই, বরং তা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতিকে স্বাভাবিকতায় রূপান্তরের একটি উদাহরণ মাত্র। এই ঘটনায় পুলিশের করা একাধিক মামলার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ‘প্রাথমিক তদন্তের’ বক্তব্য একেবারেই বিপরীত। এই বৈপরীত্যগুলো যথাযথভাবে আমলে নিয়ে গ্রহণযোগ্য তদন্ত করে জনগণকে জানাতে হবে।”

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলাতেই ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় ২৮৭ জন নিহত হয়েছেন। পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনাকে এই সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকেই বিবেচনা করতে হবে।

তবে বাংলাদেশে চলমান ‘ক্রসফায়ার’ বন্ধ হবে কি না?— বুধবার কক্সবাজারের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বেনজির আহমেদ বলেন, “ক্রসফায়ার শব্দের সঙ্গে আমরা একমত নই। এটি এনজিওরা বলে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।