র‍্যাবের দাবি, তল্লাশি চৌকিতে থামার দুই মিনিটের মধ্যেই সিনহার মৃত্যু

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2020.08.21
কক্সবাজার ও ঢাকা
200821_Major_Sinha_1000.jpg মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার মামলার অন্যতম আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশকে হাতকড়া পরিয়ে কক্সবাজারের শামলাপুরের ঘটনাস্থলে নিয়ে আসে র‌্যাবের তদন্ত দল। ২১ আগস্ট ২০২০।
[বেনারনিউজ]

কক্সবাজার জেলার টেকনাফে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের তল্লাশি চৌকিতে গাড়ি থামানোর মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করে স্থানীয় পুলিশ।

অনুসন্ধান শুরুর ১৬ দিনের মাথায় শুক্রবার ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এমনটাই জানালেন মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র‌্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার।

“মেজর সিনহাকে গুলি করার পুরো ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে। এই অল্প সময়ের প্রতিটি সেকেন্ডের ঘটনা প্রবাহ আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করছি। কারণ প্রতিটি সেকেন্ডই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” সাংবাদিকদের বলেন তিনি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীগুলো সব সময় প্রায় একই ধরনের দৃশ্যপট বর্ণনা করে। এক্ষেত্রেও প্রায় কাছাকাছি একটি বয়ান দিয়েছিল পুলিশ।”

“এক্ষেত্রেও তারা দাবি করছিল, তিনি (সিনহা) অস্ত্র তাক করে গাড়ি থেকে নেমেছেন, তর্ক করেছেন,” যোগ করেন এই মানবাধিকার কর্মী।

একই দিন সিনহা হত্যা মামলার প্রধান তিন আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়ার শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যায় র‌্যাব।

বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মৌলভি আজিজ উদ্দিন বেনারকে বলেন, “দুপুরে র‌্যাবের তদন্ত দল সাবেক ওসি প্রদীপসহ তিন আসামিকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। এরপর তাঁদের কাছ থেকে সেদিনের ঘটনা বিবরণ শোনেন।”

“এ সময় প্রদীপকে কখনো খিটখিটে মেজাজে, আবার কখনো চিন্তিত মনে হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

যেভাবে হয়েছে সরেজমিন তদন্ত

দুপুর একটায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিন আসামিকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন তদন্ত দলের সদস্যরা। দুপুর পৌনে দুইটার দিকে প্রথমে বাহারছড়ার শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক উপপরিদর্শক নন্দ দুলাল রক্ষিতকে গাড়ি থেকে নামিয়ে এপিবিএনের চেকপোস্টে নেওয়া হয়।

সেখানে সিনহা রাশেদের প্রাইভেট কারের প্রতীকি অবস্থান তৈরি করে তিনি কীভাবে গাড়ি থেকে নামেন, নেমে আসার পর কেন গুলির ঘটনা ঘটে—এসব তথ্য জানতে চাওয়া হয় নন্দ দুলালের কাছে। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে তাঁর বর্ণনা শোনে র‌্যাব।

পরবর্তীতে লিয়াকত এবং প্রদীপকে যথাক্রমে ১০ মিনিট ও আট মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিকেল তিনটার দিকে তাঁদের নিয়ে ফিরে যান তদন্তকারীরা।

“এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা,” উল্লেখ করে র‌্যাবের এডিজি কর্নেল তোফায়েল জানান, তদন্তের অংশ হিসেবেই আসামিদের নিয়ে ঘটনাস্থলে আসা হয়েছে। মূলত জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া বক্তব্যের সঙ্গে আলামতগুলো মিলিয়ে দেখতেই এই উদ্যোগ।

এটা কি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?

“গুলির ঘটনাটি তাৎক্ষণিক না পরিকল্পিত ছিল সে প্রশ্নের উত্তরও খোঁজা হচ্ছে,” বলেন কর্নেল তোফায়েল।

“প্রতক্ষ্যদর্শীদের ভাষ্যমতে লিয়াকতের হাতে আগে থেকেই অস্ত্র ছিল। হঠাৎ অভিযান হলে তাঁর হাতে অস্ত্র থাকবে কেন? আবার পুলিশের ভাষ্যমতে, মেজর সিনহাও নাকি অস্ত্র তাক করেছিল। দুই মিনিটের ভেতর কী এমন হয়েছিল, কেন তাঁদের হাতে অস্ত্র ছিল—সে বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।

নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শী এবং সাক্ষীদের কাছ থেকে যা জানা যাচ্ছে, তাতে সহজেই বোঝা যায় যে এটা ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।”

“এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই পরিকল্পনা করল, কেন করল এবং এর পেছনের রহস্যটা কী? এটা জানাই এখন তদন্তকারী এবং দেশবাসী জন্য জরুরি,” বলেন তিনি।

“দিনের পর দিন ক্রসফায়ারের নামে একই নাটক কেউ আর দেখতে রাজি না। আমরা চাই অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক। ক্রসফায়ার বন্ধ হোক, প্রচলিত আইনে সব বিচার হোক,” বলেন নূর খান লিটন।

গত ৩১ জুলাই দিবাগত রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ শেষে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান।

এ ঘটনায় তাঁর বোন শাহরিয়ার শারমিন ফেরদৌস বাদি হয়ে ৫ আগস্ট টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরির্দশক লিয়াকত আলীসহ নয় পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। সেদিনই র‌্যাবকে মামলাটির তদন্তভার দেয় আদালত।

এর আগে পুলিশের পক্ষ থেকে রামু ও টেকনাফ থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় সিনহার সহকর্মী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা রাণী দেবনাথকে আসামি করা হয়েছে। ওই মামলাগুলোও এখন র‌্যাব-১৫ তদন্ত করছে।

পুলিশের জব্দ মাল র‌্যাবকে হস্তান্তর

সিনহা নিহত হওয়ার পর পুলিশের জব্দ করা দুই লাখ টাকা, মোবাইল, ল্যাপটপ, বিভিন্ন ডিভাইসসহ তাঁর সহকর্মী শিপ্রা রাণী দেবনাথের ব্যবহৃত ২৯ ধরনের মালামাল মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করেছে রামু থানা পুলিশ।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের সাংবাদিকদের জানান, আদালতের নির্দেশে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে এসব আলামত বুঝে নেন র‌্যাব কর্মকর্তারা।

একই দিন দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে উচ্চ আদালতে শিপ্রার করা রিটটি খারিজ হয়ে গেছে। তাঁর ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক সাংবাদিকদের জানান, “আমি রিট আবেদনটি করেছিলাম। কিন্তু আদালত জানান, অন্য আবেদনকারী রিট করতে পারেন না। তাই সেটি খারিজ করা হয়েছে। অন্য কোনো আদালতে যাওয়া যায় কিনা সেটি ভেবে দেখব।”

এদিকে সিনহা হত্যা ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিবেদন জমা দেবার জন্য আরো সাত কর্ম দিবস সময় বাড়ানো হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু।

তিনি জানান, নতুন সময়সীমা অনুযায়ী কমিটি ৩১ আগস্টের মধ্যে প্রতিদেবন জমা দেবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।