প্রায় তিন দশক পর ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ, আছে সংশয়–বিতর্ক

পুলক ঘটক
2019.01.31
ঢাকা
190131_DUCSU_election_1000.JPG গণতান্ত্রিক পরিবেশে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের মিছিল। ২১ জানুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হতে চললেও ভোটকেন্দ্রে এবং আবাসিক হলগুলোতে সহাবস্থান নিয়ে বিরোধ ও বিতর্ক চলছে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে।

ইতিমধ্যে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলো। প্রয়োজনে একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। আর এসব দাবির বিরোধিতা করছে সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ।

সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনে হলে সহাবস্থান এবং একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র করার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরাও।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, "হলগুলোতে সহাবস্থান থাকতেই হবে। তবে আমার মতে, নির্বাচন হলের পরিবর্তে একাডেমিক ভবনেই হওয়া উচিত। কারণ, হলগুলোতে এখনো ভয়ের পরিবেশ আছে।”

তবে হলের মধ্যেই পোলিং বুথ স্থাপনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অনড় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মু. সামাদ বেনারকে বলেছেন, “হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা ডাকসুর গঠনতন্ত্র বিরোধী। প্রশাসন এ কাজ করতে পারে না।”

“এর আগে ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে নেওয়ারও কোনো নজির নাই,” বলেন তিনি।

গত মঙ্গলবার সিন্ডিকেট সভায় ভোটকেন্দ্র হলে রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আগামী ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে আগ্রহ ও উত্তেজনার নতুন ক্ষেত্র হয়েছে এই নির্বাচন।

১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দলীয় গণ্ডির বাইরে স্বাধীন মতামত দেওয়া শিক্ষক বা শিক্ষাবিদেরা মনে করেন, ডাকসুসহ অন্য ছাত্রসংসদ নির্বাচন হোক, এটা সরকার চায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারাও চাননি এই নির্বাচন হোক।

এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, নব্বই পরবতী সময়ে অনেকেই সরকারের ইঙ্গিতে চলতে পছন্দ করেছেন। তাই সরকার বিরক্ত হতে পারে, এমন কিছু কেউ করতে চাননি।

২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত শিক্ষার্থী-তালিকা (ডাকসুর খসড়া ভোটার তালিকা) অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী (১৮টি আবাসিক হলের সঙ্গে সংযুক্ত ও অনাবাসিক মিলিয়ে) ৩৮ হাজার ৪৯৩ জন৷ এদের মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ১৪ হাজার ৫০৯ এবং ছাত্রসংখ্যা ২৩ হাজার ৯৮৪।

এছাড়া, একটি আন্তর্জাতিক হল ও চারটি আবাসিক হোস্টেল রয়েছে৷ এ বছর (২০১৮-১৯) মোট ৭ হাজার ১২৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন৷

হলের বাইরে ভোটকেন্দ্রের দাবি কেন

বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো হল ছাত্রলীগ দখল করে রেখেছে। সেখানে ভীতিকর পরিবেশে সাধারণ ছাত্রদের অবস্থান করতে হয়।

বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক বাশার সিদ্দিকী বেনারকে বলেছেন, “হলগুলোতে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম এক রকম নিষিদ্ধ। ছাত্ররা প্রকাশ্যে ছাত্রলীগের বিপক্ষে কথা বলারও সাহস পায় না। সেখানে ভোট হলে তারা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে না।”

বামপন্থী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বেনারকে বলেন, “প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য হলগুলোতে ছাত্রলীগের অধীনে গেস্টরুম বা ‘গণরুম’ তৈরি করা হয়েছে। দশ/বরো জনের বাসযোগ্য এক একটি গণরুমে ৩০/৩৫ জন ছাত্রকে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকতে হয়।”

“তাদের ছাত্রলীগের মিছিলে যেতে এবং তাদের কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। নইলে থাকার সুযোগ নেই। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে তাকে মারধর করা হয়। অবস্থা যেখানে এ রকম, সেখানে স্বাধীন ভোটদানের পরিবেশ কোথায়?”

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বেনারকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার নতুন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। থাকার জায়গা থাকে না বলে দায়িত্বশীল ছাত্র সংগঠন হিসেবে আমরা ছাত্রছাত্রীদের অন্তর্বর্তীকালীন থাকার জন্য গণরুমের ব্যবস্থা করে দেই।”

তাঁর দাবি, সেখানে কাউকে নির্যাতন করার অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। তবে কে কোন সংগঠন করবে সেটা সর্পূর্ণ তাদের নিজেদের ব্যাপার।”

সাদ্দাম বলেন, “গণরুম শুধু ছাত্রলীগের নয়, অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোরও আছে। জগন্নাথ হলে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের বেশ কয়েকটি গণরুম আছে। তাহলে তারা ছাত্রলীগকে দোষ দেয় কীভাবে?”

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “হলগুলোতে সহাবস্থান নেই। ছাত্রলীগ একচ্ছত্র আধিপত্য করছে। তাই প্রয়োজনে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র করতে হবে।”

ছাত্রলীগ ছাত্রাবাসে ভোটকেন্দ্র চায়

ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে নিয়ে যাওয়ার দাবির বিরোধীতা করে বৃহস্পতিবার একটি বিবৃতি দিয়েছে ছাত্রলীগসহ সরকার সমর্থক ৬টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে একাডেমিক ভবনে ভোট কেন্দ্র স্থাপনের দাবির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, “একটি মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ‘ডাকসু’ ও হল সংসদ নির্বাচনের পোলিং বুথের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তির চেষ্টা করছে। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ও স্বপ্নের ক্যাম্পাসের জন্য সম্মিলিত প্রয়াসকেই অপমান করা হচ্ছে।”

“পোলিং বুথ হলের অভ্যন্তরে স্থাপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় শতবর্ষী ঐতিহ্য ও প্রথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৬৫ শতাংশই হলে অবস্থান করে। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক, প্রশাসনিক ও সহ-পাঠ্য কার্যক্রম হলকেন্দ্রিক। হল সংসদের কার্যক্রমও হলের আবাসিক বৈশিষ্ট্যকে উপজীব্য করেই।”

ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে সংগঠনগুলো

বহুল প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্র সংগঠনগুলো। এবার ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে আনার দাবিতেও তারা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত প্রতিটি ছাত্র সংগঠন নিজস্ব ব্যানারে কর্মসূচি পালন করছে। তবে দাবি আদায়ে পরিস্থিতি বুঝে জোটবদ্ধ আন্দোলনের কথাও ভাবছে সংগঠনগুলোর নেতারা।

এতে যুক্ত হতে পারে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদও। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নেতাদের মধ্যে বোঝাপড়া চলছে বলে জানা গেছে।

ছাত্রদল নেতা বাশার সিদ্দিকী বলেছেন, “হলে ভোটকেন্দ্র থাকলে নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে। যা আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখেছি। তাই একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র করার দাবি থেকে আমরা সরছি না।”

তিনি বলেন, “আন্দোলনের জন্য সব সংগঠন নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম তৈরি করতে চায় ছাত্রদল।”

তবে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দী বলেন, “আমরা ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের বাইরে বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন, মোর্চা ও বিষয়ভিত্তিক দাবিতে গড়ে ওঠা প্লাটফরমগুলোর সঙ্গে ঐক্য চাচ্ছি।”

“এর আগে ১৯৯৪ এর ২২ মার্চ ছাত্রলীগ হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়েছিল। তখনকার দখলদার ছাত্রদল এর বিরোধিতা করেছিল। এখন ছাত্রদল চাচ্ছে, ছাত্রলীগ বিরোধিতা করছে। তাই এই দুই সংগঠনের উভয়ের সঙ্গেই আমাদের ভিন্ন অবস্থান আছে,” বলেন লিটন।

সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক ফারুক হাসান বলেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনের মতামতকে অগ্রাহ্য করছে। তারা একটি ছাত্র সংগঠনকে জেতানোর জন্য ভোটকেন্দ্র হলেই রাখতে চাচ্ছে। অন্য সকল সংগঠন দাবি জানালেও গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়নি।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।