দুর্গা পূজার আবহে সর্বজনীন সংস্কৃতির মেলবন্ধন
2017.09.28
কলকাতা ও ঢাকা
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব সর্বজনীনতার রূপ নিয়েছে। শুধু হিন্দুরাই নন, সব ধর্মের মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করছেন।
“জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মেতে উঠছেন শারদোৎসবের অনাবিল আনন্দে। এটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতর বড় নিদর্শন,” বেনার নিউজের কাছে বিষয়টির প্রতিক্রিয়া এভাবেই দেন কলকাতার সাহিত্যিক আবুল বাশার।
বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙালির অবস্থান সেখানেই এই দুর্গোৎসবের আয়োজনে কোনও কার্পণ্য নেই। কলকাতা ও ঢাকায় ধর্মীয় রীতির নিয়মতান্ত্রিকতাকে ছাপিয়ে পূজা পরিণত হয়েছে মিলনোৎসবে।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বেনারকে বলেন, “আমার জানামতে এ বছর পূজার উদ্যাপনে বাংলাদেশের কোথাও শান্তি শৃঙ্খলার বড় কোনো ব্যত্যয়ের ঘটনা ঘটেনি। আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙা-এসব ঘটনা এ বছর কমে এসেছে।”
তাঁর মতে, এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে যে, সরকার এবং প্রশাসন এবার যে সিরিয়াস অবস্থান নিয়েছে সেটা যদি সারা বছর বহাল থাকে তাহলে অনাকাঙ্খিত ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বাঙালি হিন্দুদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী আশ্বিন মাসের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় দুর্গোৎসবের। অবশ্য এর ঠিক পাঁচ দিন আগে মহালয়ার মাধ্যমে দেবীর আগমন বার্তা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
দেবী দুর্গাকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির প্রতীক বলে মনে করা হয়। এ বছর কলকাতায় পথে আলপনা আঁকার মাধ্যমে দেবীকে আবাহন করেছেন আর্ট কলেজের সাড়ে তিন শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী। গত বুধবার শুরু হয়ে চার দিন ধরে চলা এই উৎসবের সমাপ্তি হবে শনিবার দশমীতে দেবীর বিসর্জনের মাধ্যমে।
প্রাধান্য পাচ্ছে শিল্পসৃষ্টি
যাদবপুর সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা সবিতা চৌধুরী কলকাতার একটি পুজো মণ্ডপে দীর্ঘ ৪০ মিনিট লাইন দিয়ে প্রবেশ করে এতটাই মুগ্ধ যে বেরিয়ে আসার সময় বেনারকে জানালেন, “মণ্ডপ আর মূর্তি দেখে সব কষ্টই দূর হয়ে গিয়েছে।”
“আমাদের ছোটবেলার দুর্গাপুজো আর এখনকার পুজোর মধ্যে গুণগত পার্থক্য অনেক। তখনকার পুজোর সামাজিক চরিত্র ছিল আলাদা। এখনকার পুজো অনেক বেশি বাণিজ্যিক,” বেনারকে বলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাশ।
শিল্পী শ্যামল নন্দী বেনারকে বলেন, “মণ্ডপ ও মূর্তি তৈরিতে এখন শিল্পসৃষ্টিই প্রধান হয়ে উঠেছে। মণ্ডপ সজ্জা থেকে মূর্তি তৈরিতে নানা ধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে। উঠে আসছে লোকশিল্পের নানা রূপ। থিমের পাশাপাশি ঐতিহ্যের মেল বন্ধনও ঘটছে।”
তিনি আরও বলেন, “পুজো নিয়ে নানা ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করার ফলে শিল্পী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে বেড়েছে বৈচিত্র্যের সন্ধান।”
এদিকে গোটা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার পুজো হচ্ছে বলে সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ পুরকায়স্থ। কলকাতায় পুজো উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে পুজো শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই।
পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, এখন বড় বাজেটের পুজোমণ্ডপগুলো অনেক আগে থেকেই খুলে দেওয়া হয়। ফলে টানা ছয়-সাত দিন ধরে চলে পুজো দেখার ভিড়। প্রায় ৫-৬ লাখ মানুষ প্রতিদিন কলকাতায় আসছেন মণ্ডপ ও প্রতিমা দেখতে।
নিরাপত্তার পরিবেশ ভালো বাংলাদেশে
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১ টায় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে পূজা দেখতে এসেছেন তাপসী রানি বাগচী। বেনারকে তিনি বললেন, “নিরাপত্তার পরিবেশ ভালো। কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করছে না। আমরা আনন্দমুখর পরিবেশেই পূজা উদযাপন করতে চাই।”
তিনি বলেন, “পূজায় আমরা সবার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করি। সব ধর্মের সকল মানুষ ভালো থাকুক, শান্তিতে থাকুক এটাই চাই। অশান্তি কাম্য নয়।”
এবারের শারদীয় দুর্গোৎসবে বাংলাদেশে গতবারের তুলনায় ৩০০টির বেশি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে । বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, এবার মণ্ডপের সংখ্যা ২৯ হাজার ৩৯৫।
পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার পাল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ‘ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করেন।
“দুর্গাপূজায় তিন দিনের সরকারি ছুটি, প্রতিটি মণ্ডপে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পূজার সময় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন ও সড়কে আলোকসজ্জার দাবি জানিয়েছি আমরা। কিন্তু ছুটি একদিনই রয়েছে,” জানান তাপস কুমার পাল।
সম্প্রীতির মেলবন্ধন
দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির যে মেল বন্ধন দেখা যায় তা আর কোনও উৎসবে দেখা যায় না বলে জানান আবুল বাশার। তিনি বলেন, “আগে মুসলমানরা পাশে থেকে পুজো উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতেন। কিন্তু এখন মুসলমানদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বেড়ে চলেছে। মূর্তি তৈরিতেও হাত লাগাচ্ছেন মুসলমান শিল্পীরা। মুসলমান প্রধান গ্রামগুলিতেও আযোজিত হয়েছে দুর্গা পুজোর। সেখানে মুসলিম ছেলে ও মেয়েরাই মণ্ডপ ও মূর্তি তৈরি করছেন হাতে হাত মিলিয়ে।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের পটাশপুরের রাজীব মোল্লা বেনারকে জানান, “ইদের মতই আমরা দুর্গাপুজোর অয়োজনে ব্যস্ত সময় কাটাই এই সময়ে।”
কলকাতার অনেক পুজো কমিটিতেই রয়েছেন সংখ্যালঘুরা। আর সম্প্রীতির মেলবন্ধনের উদ্দেশ্যে বহু পুজো এটিকেই থিম করেছে। আর এই ভাবেই পূর্ব কলকাতা সর্বজনীনের থিম রূপ পেয়েছে শিল্পী আসরফ আলি শেখের হাতে।
বাংলাদেশে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা ও খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বেনারকে বলেন, “আমরা চাই হিন্দুরা উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা উদযাপন করুক। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই এদেশের নাগরিক। দেশে সব ধর্মের মানুষ তাদের ধর্ম পালন করবে। সকল ধর্মের মানুষের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থান বজায় থাকা দরকার।