করোনার প্রভাবে উৎসবহীন দুর্গা পূজা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে
2020.10.21
ঢাকা ও কলকাতা
করোনা মহামারির প্রভাবে এবার উৎসবহীনভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে বাঙালি হিন্দুর প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।
পূজায় হচ্ছে না মেলা, শোভাযাত্রা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশেই পূজা অনুষ্ঠানে আরোপ করা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধির কড়াকাড়ি।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশে রাত নয়টার মধ্যে মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে। প্রসাদ বিতরণ করা যাবে না। ঢাকায় অষ্টমীতে কুমারী পূজাসহ বিজয়া দশমীতে হবে না কোনো শোভাযাত্রা।
অন্যদিকে কলকাতা হাইকোর্ট এক জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে গত সোমবার পশ্চিমবঙ্গের সব পূজা মণ্ডপকে নোএন্ট্রি জোন ঘোষণা করার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে। এর ফলে কোনো মণ্ডপেই দর্শক প্রবেশ করতে পারবেন না এবার।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বেনারকে জানান, “করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। তাই এবার উৎসব বাদ দিয়ে আয়োজন কেবল পূজায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।”
“সময়টা মহামারির। করোনা ভাইরাস গোটা বিশ্ববাসীর জন্য মহাসংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে,” মন্তব্য করে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, “এই অবস্থায় মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই উৎসব বন্ধ করা হয়েছে।”
“তাই পুরোহিতের আরতি সম্পন্ন হলে সন্ধ্যার মধ্যেই মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে। বাহারি আলোক-সজ্জা থাকবে না। দর্শনার্থীদের মন্দিরে আসতে নিরুৎসাহিত করা হবে,” বলেন তিনি।
২৩ অক্টোবর মহাসপ্তমীর দিন বেলা ১২টা ১ মিনিটে একযোগে বাংলাদেশের সমস্ত পূজা মণ্ডপে দেশ ও সারা বিশ্বের করোনামুক্তির জন্য প্রার্থনা করা হবে বলেও জানান নির্মল চ্যাটার্জি।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ভক্ত-পূজারি ও দর্শনার্থীদের জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা, সবার বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা, দর্শনার্থীদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ পূজায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে গত ১২ অক্টোবর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডপগুলোতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়া পুলিশ সদস্যরা দায়িত্বে থাকবেন বলে গত ১৫ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।
শুক্রবার ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে ৫দিন ব্যাপী শারদীয়া পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হচ্ছে। আগামী ২৬ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই বার্ষিক মহোৎসব।
পশ্চিমবঙ্গে বিধি মানছে না মানুষ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে পূজার কেনাকাটা করতে গিয়েই মানুষ দূরত্ববিধি মানছেন না। এ অবস্থায় পূজায় বের হলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা কঠিন হবে। তাই এবার পূজায় সবাইকে মণ্ডপে না যাবার আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সংক্রমণের আশঙ্কা উপেক্ষা করেই কলকাতার মানুষ অন্যান্যবারের মতোই বেরিয়ে পড়েছেন প্রতিমা ও প্যান্ডেল দর্শনে।
“পূজা দেখব না এটা হয় নাকি! তবে পরের দিনগুলিতে ভিড় বাড়ার আগেই দেখে গেলাম কয়েকটি প্রতিমা ও মণ্ডপ,” বেনারকে বলেন চতুর্থীর দিন কলকাতার এভারগ্রীন ক্লাবের পূজা দেখতে আসা দক্ষিণ কলকাতার গৃহবধূ শ্যামলী বিশ্বাস।
বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “এই ধরনের পরিস্থিতিতে শাস্ত্রেও বিধিনিষেধের কথা বলা রয়েছে। কিন্তু অবুঝ মানুষ আবেগ নির্ভর হয়ে বেপরোয়াভাবে মাস্ক ছাড়াই পথে বেরোচ্ছেন। সকলেরই সংযত হওয়া উচিত ছিল।”
সোমবার বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, “সমস্ত পূজা মণ্ডপের চারপাশে ৫ থেকে ১০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত ব্যারিকেড করে দিতে হবে। ‘নো এন্ট্রি’ ঘোষণা করতে হবে সেই ব্যারিকেড করা অংশকে। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।”
আদালতের এই রায়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা খুশি হলেও কলকাতার বড় বড় পূজা কমিটিগুলোর সংগঠন ফোরাম ফর দুর্গোৎসব আদালতের সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি নয়।
আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য ফোরাম এবং কয়েকটি পূজা কমিটি আবেদন জানালেও বুধবার বিচারপতিরা তা খারিজ করে আগের রায় বহাল রেখেছেন।
“আমরা কোভিড প্রটোকল মেনে পূজা মণ্ডপগুলিতে স্যানিটাইজার ব্যবহার ও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছি। দূরত্ববিধি মানার জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাখা হয়েছে থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থাও। কিন্তু আদালতের রায়ে আমরা আশাহত, বিভ্রান্ত,” বেনারকে বলেন ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সাধারণ সম্পাদক শাশ্বত বসু।
হাইকোর্টের আদেশ এবং প্রশাসনের নির্দেশনা সত্ত্বেও পূজা নিয়ে উৎসাহের কমতি নেই কলকাতার পূজা আয়োজকদের।
প্রতিবারের মতোই দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা ও অভিনব বিষয় ভাবনার নানা নজির গড়েছে এই পূজাগুলো। তবে এইবার মণ্ডপে মণ্ডপে আলোর ঔজ্জ্বল্য অনেকটাই কম। প্রতিমার আকারও অনেকটা ছোট।
কয়েকটি বড় পূজা কমিটি মণ্ডপে দর্শনার্থী ছাড়াই এ বছর পূজার ঘোষণা দিয়েছে আগেই। মহামারির কারণে বহু জায়গাতে পূজা হচ্ছে দায়সারাভাবে। কোথাও হচ্ছে ঘট পূজা।
এ বছরও প্রতিবারের মতো অনেক জায়গাতে সম্প্রীতির নিদর্শন তৈরি করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এক সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দুর্গা পূজার আয়োজন করেছেন।
রাজ্য সরকারের তথ্যমতে কলকাতায় তিন হাজারসহ এবার পশ্চিমবঙ্গে মোট ৩৪ হাজার পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে বেসরকারি হিসেবে, রাজ্যে পূজার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারের কাছাকাছি, যার মধ্যে রয়েছে হাজারের ওপর বনেদি বাড়ির পূজা।
তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশে পূজার সংখ্যা কমেছে।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের তথ্যমতে, দেশে এ বছর ৩০ হাজার ২২৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৩৯৮টি।
প্রতিবছর পূজার আগে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। মহামারির কারণে এবার আড়ম্বর এবং ভিড় দুটোই কম দেখা গেছে।
“এবার প্রতিমা বানিয়েছি পাঁচটি। অন্যান্য বছর ৮ থেকে ৯ টা প্রতিমা বানাতে হতো,” বেনারকে জানান শাঁখারীবাজারের প্রবীণ প্রতিমা শিল্পী হরিপদ পাল।
রাজ্য সরকারের তথ্যমতে, বুধবার পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ৩৩ হাজার ১২৬ জন, মারা গেছেন ছয় হাজার ২৪৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ৯৩ হাজার ১৩১ জন, মৃত্যু হয়েছে পাঁচ হাজার ৭২৩ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন চার কোটি নয় লাখ ৩২ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ১১ লাখ ২৬ হাজারের বেশি।