অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ ইজিবাইক এখন অনিবার্য গণপরিবহন

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.05.03
ঢাকা
অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ ইজিবাইক এখন অনিবার্য গণপরিবহন চট্টগ্রাম নগরীর আমবাগান সড়ক থেকে তোলা এলাকায় চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ২ এপ্রিল ২০২৪।
[মিনহাজ উদ্দিন/বেনারনিউজ]

ব্যাটারিচালিত অনিবন্ধিত ও ‘অনিরাপদ’ তিন চাকার গাড়িগুলো গণমানুষের প্রধান বাহন হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, সারা দেশে গণপরিবহন হিসেবে নিবন্ধিত বাস-মিনিবাস ও ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যা ১২ লাখের কিছু বেশি। অন্যদিকে, অনিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত এসব বাহনের সংখ্যা ৪০ লাখ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংসদকে এ কথা জানিয়েছেন।

বিআরটিএ কর্মকর্তাদের মতে, সারা দেশে এই বাহনগুলোর বিস্তারের ফলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যানজট ও দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে।

বিআরটিএ পরিচালক (প্রকৌশল) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে বাস, মিনিবাস, ট্রাকসহ কমপক্ষে ২০ ধরনের যানবাহনকে গণপরিবহন হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যানকে গণপরিবহন হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না বিআরটিএ। আমাদের আইনের আওতায় এগুলোর নিবন্ধন দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।”

তিনি বলেন, “নিরাপত্তা ও যানবাহনের ফিটনেসের বিষয়টি নিশ্চিত না করে আমরা ব্যাটারিচালিত তিন চাকার বাহনগুলোকে নিবন্ধন দিতে পারি না। এই যানবাহনগুলো একদম নিরাপদ নয়।

“ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধনের জন্য বিভিন্ন নেতারা চেষ্টা করেছেন কিন্তু ফিটনেস ও যাত্রী নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা এগুলোর ফিটনেস পরীক্ষার জন্য বিআরটিএর কাছে নিয়ে আসেন না। কারণ এগুলো ফিটনেস পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না,” যোগ করেন তিনি।

বিআরটিএর নিবন্ধন ছাড়া সারা দেশে লাখ লাখ বাহন কীভাবে চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে শীতাংশু শেখর বলেন, “বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসন এগুলোকে স্থানীয়ভাবে চলাচলের অনুমতি দেয়।”

যানজটের বিস্তার

গণপরিবহন বিষয়ক পরামর্শক ও বিআরটিএর সাবেক পরিচালক হুমায়ূন রশীদ খলিফা বেনারকে বলেন, “অবৈধ, অনিবন্ধিত ও অনিরাপদ ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক এখন দেশের প্রধান গণপরিবহন। দুঃখের বিষয়! দেশের প্রধান গণপরিবহনের কোনো বৈধতা নেই, নিবন্ধন নেই। কোনো প্রকার নিয়ম ছাড়াই অবাধে চলছে লাখ লাখ বাহন।”

তিনি বলেন, “এখন এই যানবাহনের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বিভিন্ন জেলা শহর ও উপজেলায় মারাত্মক যানজট লেগে থাকে। আগে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে যানজট ছিল। এই ব্যাটারিচালিত তিন চাকার বাহনগুলো সারা দেশে যানজটের বিস্তার ঘটিয়েছে।”

হুমায়ূন বলেন, “যানজট ছাড়াও সড়ক নিরাপত্তার জন্য এ ধরনের বাহনগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ইচ্ছা হলেই এসব গাড়িগুলো নারী-শিশু যাত্রী নিয়ে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে উল্টো দিক দিয়ে চলা শুরু করে। ফলে প্রতিবছর শত শত মানুষের মৃত্যু হয়।”

তিনি বলেন, “এগুলোর পক্ষে বিরাট একটি স্থানীয় এবং জাতীয় কায়েমি গোষ্ঠী রয়েছে, যারা এদের কাছ থেকে প্রতিদিন শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে।”

কীভাবে এগুলো সারা দেশে ছেয়ে গেল এমন প্রশ্নের জবাবে হুমায়ূন বলেন, “২০০৬-০৭ সালে আমি পরিচালক থাকাকালে এগুলো চীন থেকে আমদানি করে আনে কিছু প্রতিষ্ঠান। তারা বিআরটিএর বৈধতা চাইলে আমরা অনুমোদন দেইনি।

“তবে আমদানি বন্ধ না থাকায় এগুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে চীন থেকে ইঞ্জিন আমদানি করে স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল করা শুরু হয়। ফলে প্রতিদিনই বাড়তে থাকে এগুলোর সংখ্যা। এগুলোর ভাড়া কম। একটি পায়ে ঠেলা রিকশার ভাড়া ২০ টাকা হলে, একই দূরত্বে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের ভাড়া পাঁচ টাকা। সে কারণে মানুষ এগুলো গ্রহণ করে।”

তিনি বলেন, “আবার রিকশাচালকরা দেখল, এগুলো চালাতে শারীরিক শ্রম কম লাগে। এভাবে ধীরে ধীরে পায়ে ঠেলা রিকশাগুলো হারিয়ে গেল। ঢাকা ছাড়া দেশের কোনো স্থানে পায়ে ঠেলা রিকশা দেখা যায় না। যখন অনেক মানুষ এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল, তখন স্থানীয় নেতারা তাদের ভোট ও সমর্থনের জন্য স্থানীয়ভাবে নিবন্ধন দিতে শুরু করল।”

মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “সাধারণ মানুষ জানেন ব্যাটারিচালিত গাড়িগুলো অনিরাপদ, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে কিন্তু মানুষের উপায় নেই। ভাড়া কম, আবার তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়।”

তিনি বলেন, “সরকার যদি না চায়, তাহলে রাস্তায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশা, অটোরিকশা থাকবে না। সরকারকে আগে চাইতে হবে।”

সংখ্যা কত?

সারা দেশে কত সংখ্যক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, পায়ে ঠেলা রিকশা ও ভ্যান রয়েছে সে ব্যাপারে সরকারি কোনো হিসাব নেই। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ‘অনিরাপদ’ ও বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক বন্ধের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংসদকে জানান, “সারা দেশে ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যান রয়েছে।”

অনিবন্ধিত এসব যানবাহন বন্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো বাংলাদেশের টেসলা।”

তিনি বলেন, “ব্যাটারিচালিত এই বাহনগুলোতে লিথিয়াম ব্যাটারি সংযোজন করার সম্ভাব্যতার ব্যাপারে চিন্তা করছে সরকার।”

জ্বালানি বিভাগের অধীনে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বেনারকে জানান, ব্যাটারিচালিত তিন চাকার বাহনের কারণে দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।

তিনি বলেন, “এই গাড়িগুলো প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।”

4c3db675-3df4-4c4d-8e30-dd0adb242bdf.jpg
চট্টগ্রাম নগরীর সড়কে দাপটের সাথে চলছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ব্যাটারিচালিত রিকশা। ২ এপ্রিল ২০২৪। [মিনহাজ উদ্দিন/বেনারনিউজ]

‘অনিবার্য গণপরিবহন’

বিআরটিএ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, সারা দেশে কমপক্ষে ২০ ধরনের যানবাহনের মোট সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মোটরসাইকেল; যার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪৩ লাখ। তবে মোটরসাইকেলকে গণপরিবহন হিসেবে গণ্য করে না বিআরটিএ।

মোটরসাইকেল বাদ দিলে যাত্রী ও পণ্যবাহী গণপরিবহনের মধ্যে রয়েছে বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সি ক্যাব, হিউম্যান হলার (লেগুনা), ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ভ্যান, লরি ও অন্যান্য।

বিআরটিএ’র তথ্য অনুসারে, সংখ্যার দিক থেকে মোটরসাইকেলের পরেই রয়েছে প্রাইভেট কার। সারা দেশে প্রাইভেট কারের সংখ্যা চার লাখের বেশি। বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় ৮৩ হাজার, ট্রাক দেড় লাখের বেশি।

বাড়ছে দুর্ঘটনা

সরকারের সড়ক নিরাপত্তা শাখার পরিচালক মাহবুব-ই-রাব্বানী বেনারকে বলেন, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনগুলো সড়ক নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, “ঢাকার কিছু প্রধান সড়ক ছাড়া সারা দেশে এ ধরনের লাখ লাখ যানবাহন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতি বছর এসব যানবাহনের কারণে সারা দেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। এই বাহনগুলোর চালকদের দেশের রাস্তা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। ইচ্ছা হলেই রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে যায়। এগুলো সড়ক নিরাপত্তার জন্য একটি বিরাট সমস্যা।”

সড়ক নিরাপত্তা সেলের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে মোট ২৮০টি দুর্ঘটনায় ১৪৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে, যা মৃত্যুর শতকরা ১০ শতাংশ।

২০২৩ সালে ৯১২টি দুর্ঘটনায় ৯৩৮ জনের প্রাণহানি হয়েছিল, মোট মৃত্যুর প্রায় ১৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৬০৯টি। তবে পরের বছর সেই সংখ্যা বেড়ে চার হাজার ১৪৭ এবং ২০২০ সালে বেড়ে প্রায় পাঁচ হাজারে দাঁড়ায়।

বৈধতা চান মালিকরা

মিরপুর পল্লবী এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক সমিতির সহসভাপতি খোরশেদ আলম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “এই গাড়িগুলো মানুষকে সেবা দেয়। প্যাডেল রিকশায় ভাড়া যেখানে ৫০ টাকা, ব্যাটারির রিকসার ভাড়া ২০ টাকা। তাছাড়া, প্যাডেল রিকসায় যেতে সময় লাগে বেশি। অন্যদিকে ব্যাটারির রিকশায় খুব দ্রুত যাওয়া যায়। মানুষ এগুলো ব্যবহার করে। তাই, আমরা চাই এগুলোকে বৈধতা দেওয়া হোক।”

খোরশেদ আলম বলেন, “এসব যানবাহনের বৈধতা চেয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। আমরা চাই, এই বাহনগুলোকে বৈধতা দেওয়া হোক।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।