খরচ কম, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের অকল্পনীয় ক্ষতি : ব্যাটারিচালিত রিকশা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মত

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.05.17
ঢাকা
খরচ কম, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের অকল্পনীয় ক্ষতি : ব্যাটারিচালিত রিকশা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মত ঢাকার বাড্ডা এলাকার একটি রাস্তায় নির্বিঘ্নে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। ১৭ মে ২০২৪।
[জীবন আহমেদ /বেনারনিউজ]

শুধু ঢাকা নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে সারা দেশেই ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা বন্ধ করা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে ইজিবাইক চালকরা বলছেন, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে হঠাৎ এগুলো বন্ধ করে দিলে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে, সেই সঙ্গে বাড়বে অপরাধ।

সরকারি সিদ্ধান্তে বৃহস্পতিবার থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলাচল বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু করেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (ট্রাফিক) মো. জাহাঙ্গীর আলম।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ, যানজট হ্রাস ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বুধবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকার রাস্তায় অবৈধ ও অনিবন্ধিত এসব বাহন চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন।

সারা দেশে বর্তমানে ব্যাটারিচালিত ৪০ লাখ ইজিবাইক ও অটোরিকশা রয়েছে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

‘সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা’

রিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির পুনঃচক্রায়ন প্রক্রিয়া এবং পরিবেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) গবেষক ড. মাহবুবুর রহমান।

তিনি বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকগুলো মানুষের অগোচরে জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের অকল্পনীয় সর্বনাশ করে যাচ্ছে। খরচ কম, তাই জনগণ ব্যবহার করছে কিন্তু এর ফলাফল কেউ ভাবছে না।”

ব্যাটারিতে ব্যবহৃত সিসা “ধ্বংস হয় না” বরং “প্রকৃতিতে থেকে যায়” মন্তব্য করে তিনি বলেন, এসব রিকশার “অচল ব্যাটারি ভেঙে সিসা বের করার জন্য শিশু ও দরিদ্র মানুষদের নিয়োজিত করে কিছু কোম্পানি—যার মালিকদের ধরা যায় না।”

d3ce20af-2b27-426f-9e32-89c8290e6674.jpg
ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা । ১৭ মে ২০২৪। [জীবন আহমেদ /বেনারনিউজ]

তিনি বলেন, শ্রমিকরা ব্যাটারি ভেঙে ভেতরের সিসা পরিষ্কার করতে পানি ব্যবহার করেন। সেই পানি নদী-নালা, খাল-বিল ও কৃষি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে পানি ও মাটি দূষণ করে।

“এই দূষিত পানির জলাশয়ে বেড়ে ওঠা মাছের শরীরে সিসা প্রবেশ করে। আবার সিসাযুক্ত পানি কৃষি কাজে ব্যবহার করলে খাদ্য চক্রের মাধ্যমে সিসার কণা মানবদেহে ও পশু-পাখির শরীরে প্রবেশ করে,” বলেন মাহবুবুর রহমান।

গবেষণার অংশ হিসেবে ঢাকার সাভার ও টাঙ্গাইলে ব্যাটারি পুনঃচক্রায়ন কারখানার আশেপাশে বসবাস করা মানুষের রক্ত পরীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যের আলোকে তিনি বলেন, “একটি শিশুর রক্তে প্রতি ডেসিলিটারে ৪৬ মাইক্রোগ্রাম সিসা পাওয়া গেছে। যেখানে রক্তে সিসার সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য পরিমাণ সাড়ে তিন মাইক্রোগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার।”

“সিসার কারণে মানুষের আইকিউ লেভেল কমে যায়, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। সিসা হাইপারটেনশন ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের জন্যও দায়ী,” বলেন মাহবুবুর রহমান।

ব্যাটারিচালিত প্রতিটি বাহন বছরে “কমপক্ষে ৩০০ কেজি সিসা পরিবেশে যোগ করছে” জানিয়ে বৃহস্পতিবার পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সাবেক পরিচালক হুমায়ূন রশীদ খালিফা বেনারকে বলেন, “সেই হিসাবে ১০ বছরে ৪০ লাখ যানবাহনের মাধ্যমে ১২ বিলিয়ন কেজি সিসা যোগ হচ্ছে।”

২০০৬-০৭ সালের দিকে একটি প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম চীন থেকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক আমদানি করে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রকৌশল) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস।

তিনি বলেন, “এগুলোর ডিজাইন এবং ফিটনেস পরীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় নিবন্ধন ও রুট পারমিট দেওয়া হয়নি। একটু ঝাঁকুনি লাগলেই উল্টে যায়।”

তবে পরবর্তীতে আমদানিকারকরা এগুলো আমদানি চালিয়ে যান এবং গ্রামাঞ্চলে বিক্রি শুরু করেন। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের অনুমতি নিয়ে এগুলো স্থানীয়ভাবে চলাচল করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে এর সংখ্যা ৪০ লাখে দাঁড়ায় বলে জানান তিনি।

“তারা বিআরটিএর অনুমতির কথা চিন্তা করে না,” মন্তব্য করে শীতাংশু বলেন, “ব্যাটারিচালিত তিন চাকার বাহনগুলো কমপক্ষে শতকরা ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।”

66ac9a33-673d-4e6b-9a5c-93dc528b5684.jpg
ঢাকার কেরানীগঞ্জের সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অটোরিকশা। ০৭ মে ২০২৪ [মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

দুশ্চিন্তা জীবিকা ও জনভোগান্তি

ঢাকার পল্লবী এলাকার দুয়ারিপাড়ার ইজিবাইক চালক আব্দুর রশীদ বৃহস্পতিবার সতর্কতার সঙ্গে ‘গাড়ি’ চালিয়েছেন জানিয়ে বেনারকে বলেন, “চিন্তায় আছি, কালকে থেকে হয়তো রাস্তায় নামতে পারব না। সংসার কীভাবে চালাব সেটাই চিন্তা করছি।”

ইজিবাইক ও অটোরিকশা বন্ধ করে দেওয়া হলে অসংখ্য মানুষ কাজ হারাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “সারা দেশে ছিনতাই, চুরি, রাহাজানিসহ খারাপ কাজ বাড়বে; ইজিবাইক ও অটোরিকশার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত।”

এদিকে ইজিবাইকের ভাড়া পায়ে টানা রিকশা ভাড়ার ‘প্রায় অর্ধেক’ এবং এগুলোর সহজলভ্যতার কারণে মানুষ ইজিবাইক ও অটোরিকশা ব্যবহার করে বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান উপসচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তা আজিজুর রহমান।

তাঁর মতে, একটি সার্বিক পরিকল্পনার আওতায় এগুলোকে “ধীরে ধীরে” রাস্তা থেকে সরানো উচিত। রাতারাতি বন্ধ করে দিলে ‘জনভোগান্তি’ সৃষ্টি হতে পারে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।