ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেল সরকার
2024.05.20
ঢাকা
পাঁচদিনের ব্যবধানে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলো সরকার।
দুর্ঘটনা রোধে রাজধানীতে এসব যান চলাচল বন্ধ ঘোষণার পর দু’দিনব্যাপী চালকদের আন্দোলনের মুখে সোমবার আবারো তা চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঢাকায় ব্যাটারিচালিত তিন চাকার বাহন চলবে না—বলে গত ১৫ মে ঘোষণা দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আবার তিনিই সোমবার ঢাকায় এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালু রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
নিম্নআয়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দিয়েছেন বলে তিনি জানান।
সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব নির্দেশনা দেন বলে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটি (ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত) প্রধানমন্ত্রী জানতেন না। তিনি বলেছেন তাঁর নজরে আনা হয়নি। জীবিকার ব্যবস্থা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যৌক্তিক মনে করেননি প্রধানমন্ত্রী।
সরকারি ঘোষণার পরই সোমবার বিকাল থেকে মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত বাহকগুলো রাস্তায় নেমে পড়ে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্ধের ঘোষণার পরেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা সরকারের দ্বিধার বহি:প্রকাশ। এর ফলে ইজিবাইক চালকরা আরও বেশি বেপরোয়া হবে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং বিশৃঙ্খলাও বাড়বে।
ব্যাটারিচালিত ইজি বাইকের নেতা খোরশেদ আলম সোমবার রাতে বেনারকে বলেন, “আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি এবং একটি আনন্দ সমাবেশ করব।”
তিনি বলেন, “এখন আমরা চাই গাড়িগুলোকে আইনি আওতায় আনার জন্য বিআরটিএ আমাদের নম্বর প্লেট দেবে।”
আলম বলেন, আমরা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে স্মারকলিপি দেব।
‘সরকার সিদ্ধান্তহীনতায়’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাবেক পরিচালক হুমায়ূন রশীদ খলিফা সোমবার বেনারকে বলেন, “হঠাৎ করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এবং হঠাৎই তা প্রত্যাহার। এর অর্থ হলো, এ ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্তহীনতায়।”
তিনি বলেন, “ব্যাটারিচালিত তিন চাকার বাহনগুলো অনেক আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল। এই সংখ্যা বৃদ্ধির আগেই ব্যবস্থা নিলে আজকে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতো না।”
হুমায়ূন রশীদ বলেন, “এর ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। দুর্ঘটনা বাড়বে। এবং এই সকল বাহনের মালিক-চালকরা আরও বেপরোয়া হবে। এটি কোনো ভালো নজির সৃষ্টি করল না।”
হুমায়ুন রশীদ বলেন, “এই দৃষ্টান্তের ফলে অন্যান্য পরিবহন শ্রমিকরাও রাস্তায় সহিংসতা করে তাদের অনায্য দাবি আদায় করে নেবে।”
তিনি বলেন, “কেবল দুর্ঘটনা নয়। ব্যাটারির রিকশা দেশের কোটি কোটি মানুষকে সিসা দুষণে আক্রান্ত করছে। প্রতিবছর লাখ লাখ টন সিসা ব্যাটারি পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। মারাত্মক দুষণকারী এই সিসা মানুষ, মাছ, গরু-ছাগল, ধান, সবজি সবকিছুই দুষিত করছে। অথচ এগুলোকে বলা হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব।”
একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে আমদানি বন্ধ করে ধীরে ধীরে সারাদেশ থেকে ব্যাটারিচালিত বাহন বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন বিআরটিএর সাবেক এই পরিচালক।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ সোমবার বেনারকে বলেন, অর্থনীতির নাজুর অবস্থা, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ সঙ্কট সবকিছু মিলিয়ে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়ে বলা যায়।
তিনি বলেন, “ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইক চালকরা দরিদ্র। তাদের রুজি বন্ধ হলে তারা রাস্তায় নামবে। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চালকদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।”
নিজাম উদ্দিন বলেন, “আমার মনে হয়, সরকার এই অবস্থায় কোনো মানুষকে আন্দোলনে দেখতে চায় না। সেই কারণে তারা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিক্সার ব্যাপারে অবস্থান পরিবর্তন করল। বিরোধীদলকেও রাস্তায় আন্দোলনের সুযোগ দিলো না।”
“তবে, রুজির কথা বলে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা উচিত হয়নি সরকারের। রুটি-রুজির রক্ষা করতে গিয়ে সড়কে মানুষের প্রাণহানি করতে দেয়া তো কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়,” বলেন তিনি।
কীভাবে শুরু হলো?
১৫ মে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ ভবনে অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে দেশের সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানানো হয়, ঢাকাসহ সারাদেশে ৪০ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিক্সা ও অন্যান্য তিন চাকার বাহন চলাচল করছে সেগুলো নিবন্ধিত নয় এবং রাস্তায় চলার কোনো ফিটনেস নেই। এছাড়া চালকদের প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স কিছুই নেই।
গত কয়েক বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ব্যাটারিচালিত যানবাহনের কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে শতকরা ১৫ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে যা প্রতিরোধযোগ্য।
আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা ও অটোভ্যান চলবে না।
এই ঘোষণা কার্যকর করতে রোববার ব্যাটারিচালিত তিন চাকার বাহন বন্ধে রাস্তায় অপারেশন শুরু করলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ইজিবাইকের মালিক ও চালকেরা। তবে সবচেয়ে বেশি সহিসংসতা ছড়িয়ে পড়ে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচক্করসহ আশেপাশের এলাকায়।
মিরপুর কালশী এলাকায় একটি পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণে আনতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপসহ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে একজন আহত হন। ভাংচুর করা হয় বিভিন্ন বাস ও প্রাইভেট কার।
সহিংস এই ঘটনায় মোট তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। সোমবার কমপক্ষে পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ।
বিরোধীদল বিএনপিসহ বামপন্থী দলগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। চালকদের পক্ষ থেকেও আন্দোলন অব্যাহত রাখার আসে।
সোমবার ব্যাটারিচালিত বাহনের চালকদের নেতারা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেন, সরকার এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করলে ২৭ মে থেকে সারাদেশে কঠোর আন্দোলন শুরু করা হবে।
সভায় জানানো হয়, ঢাকায় পাঁচ লাখ ব্যাটারিচালিত বাহন চলাচল করে।
আন্দোলনকারীদের নেতা জালাল আহমেদ সমাবেশে বলেন, ব্যাটারিচালিত বাহন নিষিদ্ধ হওয়ায় লাখ লাখ পরিবার অনাহারে ভুগছে। সরকারকে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে।
সরকারের পিছুটান
রাষ্ট্রীয় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানায়, সোমবার এক আলোচনা দলীয় কার্যালয়ে এক আলোচনা সভায় ওবায়দুল কাদের বলেন, “দুর্মূল্যের বাজারে মেহেনতি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা এবং বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঢাকা সিটি এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।”
তিনি বলেন, “আমরা নতুন নীতিমালা নিয়ে আসছি। জীবিকা আগে না জীবন আগে। যদি ট্রাক ও বাসের সঙ্গে ইজিবাইকের সংঘর্ষ হয় তাহলে বাসের কারো কিছু হয় না। ইজিবাইকের ড্রাইভারসহ ১০-১২ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন। এই অবস্থায় ২২টি মহাসড়কে আমরা ইজিবাইক বন্ধ করেছি।”
সেতুমন্ত্রী বলেন, “বিআরটিএ-কে আমি বলেছি, এদের (অটোরিকশা চালক) প্রতিনিধিদেরকে ডাকবেন, কথা বলবেন। ড্রাইভারদের ট্রেনিং দিতে হবে এবং গাড়ির সাইজ একটা নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। গাড়ির সাইজ, চাকা এগুলো যেন বাস্তবসম্মত হয়। এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বিআরটিএ সবাইকে পৌঁছে দেবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।”