ব্যাংকে তারল্য সংকট, বাড়ছে সুদের হার

পুলক ঘটক
2018.03.14
ঢাকা
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। ১৪ মার্চ ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

প্রায় তিন বছর উদ্বৃত্ত তারল্য হাতে নিয়ে অতিমাত্রায় ঋণ বিতরণের পর হঠাৎ করে নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংকগুলো। বেশ কিছু ব্যাংক নতুন করে ঋণ দিতে পারছে না। প্রায় সব ব্যাংকই বাড়িয়েছে সুদের হার।

নগদ অর্থ সংকটের কারণে বাড়তি সুদে আমানত সংগ্রহের জন্য নানারকম চেষ্টা করছে ব্যাংকগুলো। আগে যেখানে ৩ থেকে ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করত, এখন সেখানে ৮ থেকে ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে।

নগদ চাহিদা মেটাতে ছোট ব্যাংকগুলো ধরনা দিচ্ছে বড় সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে। গত এক মাসে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালি, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক থেকে ২০০ বিলিয়ন টাকারও বেশি মেয়াদি আমানত ধার নিয়েছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেছেন, “বেসরকারি ব্যাংক থেকে কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান আমানত তুলে নেওয়ায় এবং নতুন করে আমানত না আসায় এ সংকট তৈরি হয়েছে।”

তিনি বলেন, “পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলো বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে। ফলে ঋণের সুদ হারও বেড়েছে।”

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বেনারকে বলেন, “নতুন বছরের শুরু থেকেই ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেড়েছে। ফলে বিনিয়োগ ও ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।”

তবে তারল্য সংকটের কথা অস্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বেনারকে বলেছেন, “অহেতুক ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। ভীতির কারণে কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়ায় সাময়িক চাপ তৈরি হয়েছে।”

ঋণের সুদহার বৃদ্ধি

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মাস দু-এক আগেও ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের ৮-৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিত, যা এখন ২-৩ শতাংশ বেশি দিতে হচ্ছে। একইভাবে বেড়ে গেছে ভোক্তা ও গৃহঋণের সুদের হারও।

গত ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে ঋণের সুদ হার বাড়ায় ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে ১৯ টি ব্যাংকের সুদ হার গড়ে দুই অঙ্কের ঘরে গিয়ে ঠেকে। ক্ষেত্রবিশেষে সুদের হার লাফিয়ে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে উঠেছে।

হঠাৎ করে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। “ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে আবার বাড়বে পণ্যের দাম। ফলে নাগরিকদের ভোগান্তি আরও বেড়ে যাবে,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ।

তিনি বলেন, “ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা ওঠাতে না পেরে তাদের দায় ভালো উদ্যোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

কেন এই সংকট?

নিয়ম না মেনে কোনো কোনো ব্যাংক বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়েছে; যা গোটা ব্যাংকিং খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অনেক গ্রহীতা ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৭ সালের প্রথম ১১ মাসেই (জানুয়ারি থেকে নভেম্বর) ১ হাজার ১১৫ বিলিয়ন টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে।

এ সময়ে ব্যাংকগুলোতে আমানত এসেছে ৭২৫ বিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে দেড় গুণের বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ফলে অধিকাংশ ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ে যায়।

তবে ব্যাংকাররা হঠাৎ এই সংকটের পেছনে আরও কিছু কারণ দেখছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের সীমা কমিয়ে দেওয়া।

সুদের হার কম হওয়ায় ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়ায় সংকট বেড়েছে।

আমদানি ব্যয় পরিশোধ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকে পড়ে।

এ ছাড়া, সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তিনটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন টাকা তুলে সরকারি ব্যাংকে জমা করেছে। এতে বেকায়দায় পড়েছে বেসরকারি খাতের ওই তিনটি ব্যাংক।

এবিবি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “কোনো কারণ ছাড়াই সরকারি প্রতিষ্ঠান টাকা তুলে নিচ্ছে। দেশের অর্থনীতির ৭০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ সরকারি আমানতের মাত্র ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাখা হচ্ছে। এই হারকে ৫০ শতাংশ করা দরকার।”

তিনি বলেন, “সরকারি আমানতের অন্তত অর্ধেক অর্থ পাওয়া গেলে বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেন, “দেশের সাতটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪.১৭ বিলিয়ন টাকা।

এর মধ্যে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালি, রুপালি, জনতা ও বেসিকের ঘাটতির পরিমাণ ৭৬.২৬ বিলিয়ন টাকা।

আর তিন বেসরকারি ব্যাংক কমার্স, ফারমার্স ও আইসিবি ইসলামি ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি ১৭.৯১ বিলিয়ন টাকা।

এর আগে গত জানুয়ারিতে অর্থমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন, গত ১০ বছরে ৬৫৬ বিলিয়ন টাকা নতুন করে খেলাপি হয়েছে। শ্রেণিকৃত ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২০.৫০ বিলিয়ন টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা

অতিরিক্ত হারে ঋণের কারণে তারল্য সংকট ঠেকাতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৩০ জানুয়ারি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সার্কুলার অনুযায়ী, সাধারণ ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা ঋণ দিতে পারবে।

আগে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ঋণ দিতে পারত। আর ইসলামি ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারবে সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা পর্যন্ত। ইসলামি ব্যাংকগুলো আগে দিতে পারত ৯০ টাকা পর্যন্ত। যাদের এর চেয়ে বেশি আছে তাদের জুনের মধ্যে নামিয়ে আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে গভর্নর ফজলে কবির বেনারকে বলেন, “অনেক বেসরকারি ব্যাংক অ্যাগ্রেসিভ লেন্ডিং করছিল। ডিসিপ্লিনের প্রয়োজনে অ্যাডজাস্টমেন্ট করেছি।”

তিনি বলেন, “ঋণ ও আমানতের নির্ধারিত অনুপাত সীমা লঙ্ঘন করে প্রায় ১১০ বিলিয়ন টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে বেশ কিছু ব্যাংক। সেটি কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। এটা পুরো ব্যাংক খাতকে প্রভাবিত করার কথা নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।