সরকারের হিসাবে জিডিপি এই প্রথম ৭ শতাংশ ছাড়াবে
2016.04.05

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন হচ্ছে, চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি প্রথমবারের মতো ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে হবে ১ হাজার ৪৬৬ ডলার।
সরকার ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবির মতে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি ও হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে এডিবি ৩০ মার্চ প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস তুলে ধরে।
তবে বিবিএস গতকাল মঙ্গলবার ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্য বিশ্লেষণ করে মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই হিসাব তুলে ধরে হয়।
এসময় বৈঠকস্থলে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন ঠিক থাকলে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হবে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে।
উল্লেখ্য, গত অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের শুরুতে বাজেট ঘোষণার সময় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছিল।
“অনেক দিন ধরে দেশে ও দেশের বাইরে বলাবলি হচ্ছিল, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ঘরে আটকে গেছে। এবার তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে,” জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
মুস্তফা কামাল বলেন, “আগে বিশ্ব ব্যাংক ও ইউএনডিপি আমাদের অর্থনীতির প্রশংসা করত। এখন ইউরোপও বলছে বিনিয়োগের পরবর্তী ঠিকানা বাংলাদেশ।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এক বছরেই মাথাপিছু আয় বেড়েছে দেড়শ ডলার। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৩১৬ ডলার।
জিডিপি বাড়ার কারণ
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতে যে সাময়িক তথ্য পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে জিডিপি বাড়ার এ পূর্বাভাস দিয়েছে বিবিএস।
“শিল্প ও সেবা খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে, কৃষি খাত পিছিয়ে থাকলেও বিগত অর্থ বছরের তুলনায় এ বছর কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ভালো দাম পেয়েছেন,” বেনারকে জানান বিবিএসের মহাপরিচালক আবদুল ওয়াজেদ।
এদিকে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে দেশে মোট জিডিপি’র ২৯ দশমিক ৬৮ ভাগ বিনিয়োগ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে ২ দশমিক ৬০ ভাগ, শিল্প খাতে ১০ দশমিক ১০ ভাগ এবং সেবা খাতে ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ।
বিবিএস জানিয়েছে, এ ছাড়াও মৎস্য খাতে ৬ দশমিক ১৯ ভাগ, খনিজ সম্পদে ১২ দশমিক ০৬ ভাগ, শিল্প উৎপাদনে ১০ দশমিক ৩০ ভাগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ খাতে ১১ দশমিক ১৫ ভাগ, নির্মাণ শিল্পে ৮ দশমিক ৮৭ ভাগ, হোটেলে রেস্তোরাঁ খাতে ৭ ভাগ এবং পরিবহন খাতে ৬ দশমিক ৫১ ভাগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এডিবির ভিন্নমত
সরকার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবির মতে, চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে সংস্থাটি বাংলাদেশের অর্থনীতির হালনাগাদ যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তাতেও চলতি অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এখন এসেও সংস্থাটি একই প্রক্ষেপণ করছে।
চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরেরও প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করেছে এডিবি। সংস্থাটির মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৯ শতাংশে। প্রবৃদ্ধির এই গতি ধরে রাখতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা লাগবে।
এডিবি বলছে, প্রবৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের সক্রিয় পরিবেশ দরকার। এ ছাড়া নতুন মূসক বা ভ্যাট আইন কার্যকর, ভূমি রেকর্ড ও ভূমির হাতবদল ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন, রপ্তানির বাধা দূর, তেল ও বিদ্যুতের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা শক্তিশালী করার দিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে।
অবাস্তব উচ্চাশা
সরকার বা এডিবির প্রক্ষেপণকে ‘অবাস্তব’ বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম । তাঁর মতে, সরকারের হিসাবে সাড়ে সাত বা এডিবির হিসাবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ‘অবাস্তব উচ্চাশা’।
মির্জ্জা আজিজ বেনারকে বলেন, “প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। সেখানে গত আট মাসে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যে অবস্থা চলছে সেটি সবাই জানে। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই প্রবাসী-আয়ের ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রায় অসম্ভব। অন্য যেসব সূচক রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত কর আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।”
উৎপাদন ক্ষমতা, আমদানি, রপ্তানিসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে প্রবৃদ্ধি আগের বছরের চেয়ে বেড়ে ৬ দশমিক ৭ বা সাড়ে সাত শতাংশে যাবে—এটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন না মির্জ্জা আজিজ।