বেশি প্রবৃদ্ধির ৫ দেশের একটি হবে বাংলাদেশ: বিশ্বব্যাংক

জেসমিন পাপড়ি
2019.04.04
ঢাকা
190404_world_bank_report_1000.jpg চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ। ছবিটি ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে তোলা। ২০ মার্চ ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পর বাংলাদেশের জন্য সুখবর দিয়ে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী পাঁচ দেশের একটি হবে বাংলাদেশ।

বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়।

এ বছর প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা এডিবি ও সরকারের দেওয়া আভাসের চেয়ে কিছুটা কম। তবে এই প্রবৃদ্ধিও অনেক বলে মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর রবার্ট জে সউম।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে সুখবর দিলেও বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বল খাত ব্যাংক। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন এবং রাজস্ব আদায়ে নজর না দিলে এসব পূর্বাভাস বাস্তবে রূপ নেওয়া কঠিন হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, “ব্যাংকিং খাত নিয়ে বিশ্বব্যাংক যা বলেছে তা নতুন নয়। এ খাতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। কোনো রকম নিয়ম কানুন কাজ করছে না।”

তিনি বলেন, “সবার মতের বিরুদ্ধে যে ব্যাংকিং খাতে অবিরাম অনিয়ম করা হচ্ছে। ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ খাত ভালো দেখানোর জন্য ঋণ হিসাব থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে। এসব অনেক দিন ধরে হচ্ছে।”

“এখনই এসব দিকে নজর না দিলে পূর্বাভাস পূর্বাভাসই থাকবে,” বলেন তিনি।

অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ব্যাংকিং খাতকে এখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে। এখানে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে।”

“এ ছাড়া রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। রাজস্ব আদায় না হলে বিভিন্ন কল্যাণমূলক এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারবে না সরকার। ফলে পিছিয়ে পড়বে অর্থনীতি,” বলেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশের আগের দিন গত বুধবার চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আট শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

এর আগে গত মার্চের মাঝামাঝি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসেব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৩ শতাংশ

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলেও রপ্তানি ও রেমিটেন্সে কারণে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে।

রপ্তানি, আমদানি, রাজস্ব আদায়, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং সরকারি বিনিয়োগসহ অর্থনীতিক সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে চলতি অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে জানান বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, দেশে গত কয়েক বছর সরকারি বিনিয়োগ ছিল প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী দিক। তবে এবার কিছুটা রপ্তানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধির ধারা দেখা যাচ্ছে।”

৭ দশমিক ৩ প্রবৃদ্ধি অনেক মন্তব্য করে রবার্ট জে সউম বলেন, “বিশ্বে যে পাঁচটি দেশের জিডিপি সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।”

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে কেবল বাংলাদেশের চেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ইথিওপিয়া (৮.৮ %), রুয়ান্ডা (৭.৮ %), ভুটান (৭.৬ %) এবং ভারতের (৭.৫ %)। এ ছাড়া জিবুতি, আইভরি কোস্ট, ঘানা-এই চারটি দেশেরও বাংলাদেশের সমান প্রবৃদ্ধি হবে।

তিনি জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানিতে ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে পোশাক খাতের ১৪.২ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৭.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

এ ছাড়া মেগা প্রকল্প এবং রেমিটেন্সও জিডিপি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে বলে জানান তিনি।

তবে এবারও রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি খুবই কম জানিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, গত সাত মাসে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি খরচ করতে পারলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না।”

খেলাপি ঋণ ছোঁয়াচে রোগ

বিশ্বব্যাংকের মতে, খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশ বাড়লে ৬টি ব্যাংক, ৯ শতাংশ বাড়লে ২৯টি ব্যাংক এবং ১৫ শতাংশ বাড়লে ৩৫টি ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি দেখা দেবে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবার ভালো ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ৩ শতাংশ গ্রহীতা খেলাপি হলে ২১টি, ৭ শতাংশ হলে ৩১টি এবং ১০ শতাংশ খেলাপি হলে ৩৫টি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি তৈরি হবে।

জাহিদ হোসেন বলেন, “যদি এই দুটি খাতে একই সময়ে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে এতে ঘূর্ণিঝড় নয়; দেশের অর্থনীতিতে মেঘ ঘনীভূত হবে।”

তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ একটি ছোঁয়াচে রোগ, ঋণ পুণঃতফসিলীকরণ এটি আরও বাড়িয়ে দেয়। বারবার একই ব্যক্তিকে একই যুক্তিতে পুনঃ তফসিলের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে না।”

ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার তাগিদ দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি দক্ষতা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তবে কোনো সমস্যা হয় না। আবার সব ব্যাংককে এক পাল্লায় মাপাও ঠিক হবে না।”

এছাড়া রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, “এসব ব্যাংকের মালিক জনগণ। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মালিকানার ভূমিকা পালন করে। নিয়ন্ত্রক ও মালিকের ভূমিকা এক নয়। তাই আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।”

এই অবস্থায় টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য আর্থিক খাতের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আর্থিক খাত, অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক বিধি-নিয়ম কার্যকর করতে হবে। ”

বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ভূ-রাজনীতি, তেল সরবরাহ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ব্রেক্সিট প্রভৃতি কারণে ২০১৯ সালের পর বিশ্ব অর্থনীতি শ্লথ হয়ে আসতে পারে।

এই শ্লথ গতির মধ্যেও বাংলাদেশ ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তবে আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অর্থনীতির ঝুঁকি রয়েছে বলেও জানান।

তাঁর মতে, “অর্থনৈতিক চাতুর্য দিয়ে বৈদেশিক অর্থনীতির ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। আর আভ্যন্তরীণ ঝুঁকির মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংক খাত। রাজস্ব আদায়ে অপর্যাপ্ততাও আরেকটা ঝুঁকি। এ ছাড়া অন্যান্য ঝুঁকি যেগুলো ছিল তা মোটামুটি কেটে গেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।