পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ড কেজি ২০০ টাকা
2019.11.14
ঢাকা
বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকা ছুঁয়েছে। যা স্মরণাতীত কালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। তারপরেও কবে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে তা বলতে পারছেন না কেউই।
গত বুধবার জাতীয় সংসদে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন প্রশ্নোত্তর পর্বে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দাবি করেন। এর একদিন পরেই ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা পেঁয়াজের দাম কেজিতে দুইশতে পৌঁছায়।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের একাধিক সাংসদ পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি এ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন জাতীয় সংসদে।
এর আগে বুধবার সংসদে শিল্পমন্ত্রী বলেছিলেন, “ভারতে হঠাৎ বন্যার কারণে আমাদের পেঁয়াজের বাজার গরম হয়ে যায়। এ সময় ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিও বন্ধ করে দেয়। তবে আমরা দ্রুত তা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি।”
তিনি বলেন, “পরিস্থিতি মোকাবিলায় মিয়ানমার ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।”
মাঠে সরকার নির্ধারিত দামের বাইরে যেন কেউ পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পারে সে জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতার কথাও জানান মন্ত্রী।
তবে সরকারি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, তারা ৪৫ টাকা কেজি দরে ৩৫টি ট্রাকে করে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পেঁয়াজ বিক্রি করছে এবং প্রতিদিনই ক্রেতার সারি দীর্ঘ হচ্ছে।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “আমরা ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে পেঁয়াজ বিক্রি করছিলাম। প্রথমে জনপ্রতি দুই কেজি করে দিতাম। গত সপ্তাহ থেকে এক কেজি করে দেওয়া হচ্ছে। ক্রেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় এখন আমাদের লক্ষ্য অল্প করে হলেও সবাই যেন পায়।”
পেঁয়াজ ও অন্যান্য মসলা আমদানিকারকদের সংগঠন শ্যামবাজার বণিক সমিতির সহ–সভাপতি মো. হাফিজ জানান বাজার পরিস্থিতি আসলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
“আমরা মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আনছিলাম। এখন মিয়ানমারও আর পেঁয়াজ দিচ্ছে না। তারাও তাদের দেশে ঘাটতির কথা বলছে,” বেনারকে বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই বাজারে পেঁয়াজের সংকট দেখা দেয়, সেই সংকটই এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় মসলা হিসেবে পেঁয়াজ একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। দরিদ্র মানুষের প্রধান খাবার ভাতের সঙ্গে ডাল ও ভর্তা দুটোতেই পেঁয়াজ ব্যবহার হয়। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের খাদ্যতালিকার বড় অংশে পেঁয়াজের ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে সবার ওপরই এই দাম প্রভাব ফেলেছে।
আনোয়ারা বেগম পান্থপথে গৃহকর্মীর কাজ করেন। বেনারকে তিনি বলেন, “ডালে বাগার দিতে পেঁয়াজ তো লাগেই, এখন দিই না বললেই হয়। রসুনটা বাড়ায়া দিই। হালি হিসেবে পেঁয়াজ কিনি। চারটায় দুই-তিনদিনি চালাই।”
চিকিৎসক ইফফাত আরা বেনারকে বলেন, “আমি বাসায় মাছের ঝোলটা ঘন করতে পেঁয়াজের বদলে পেঁপে বাটা দিতে বলেছি। কুলানো যাচ্ছে না।”
যে কারণে সংকট
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে দেশেই উৎপাদিত হয় ২৩ দশমিক ৩১ লাখ টন। সংগ্রহের সময় ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মোটের ওপর দেশীয় জোগান ১৬ দশমিক ৩১ লাখ টন।
শিল্পমন্ত্রী গতকাল সংসদে বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে আরও কয়েক সপ্তাহ বাকি। প্রতিবছরের মতো এবারও এই সময়টায় পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। অন্যান্য বছর ভারত থেকে আমদানি করে ঘাটতি মেটানো হয়। এবার ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ হওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়।
টিসিবির হিসেবে খুচরো বাজারে সোমবার পেঁয়াজের দাম ছিল ১১৫-১৩৫ টাকা, মঙ্গলবার তা পৌঁছায় ১২৫-১৪৫ টাকায়। বুধবার বাজার ঘুরে পেঁয়াজ ১৮০ টাকায় এবং সবশেষ বৃহস্পতিবার ২০০ টাকায় কিনতে হয়েছে ক্রেতাদের।
ভারত রপ্তানি বন্ধের পর বাংলাদেশ বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভারতের বিকল্প সাতটি দেশ থেকে ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ আনার জন্য ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খুলেছেন। এই দেশগুলো হলো উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, মিসর, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে মাত্র ৫ হাজার টন। বাকি ৬১ হাজার টন নভেম্বরের শেষ ভাগে ও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পৌঁছানোর কথা।
তবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগও আছে। ভারত আমদানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি নামে একটি সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে গত ৩ নভেম্বর বলে, পেঁয়াজের বাজার একটি সিন্ডিকেটের দখলে। জুলাই মাস থেকে পরবর্তী চারমাসে মোট ২৪ বার পেঁয়াজের দাম ওঠানামা করেছে। ভোক্তার ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও রেয়াজউদ্দিন বাজারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সেলিম হোসেনের নেতৃত্বে ৪ নভেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। অভিযান শেষে তাঁরা জানান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের টেকনাফভিত্তিক পেঁয়াজ আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আড়তদারদের ১৫ জনের একটি সিন্ডিকেটের কথা জানানো হয়। এরপর তাঁরা পেঁয়াজের পাইকারি মূল্য ৫৫ থেকে ৬০ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেন।
তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
প্রধানমন্ত্রী যা বললেন
পেঁয়াজের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের একাধিক সাংসদ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।
এসব সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। একটা প্রদেশ ছাড়া সারা প্রতিবেশী ভারতেও ১০০ রুপিতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তারাও বিদেশ থেকে আমদানি করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে, পেঁয়াজ পঁচে গেছে। বিক্রি করা হচ্ছে না।
শেখ হাসিনা বলেন, টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। মিশর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। অন্য বাজার খোঁজা হচ্ছে।”
“৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে চলে আসবে। টিসিবি বিতরণ করবে। ট্রাকে করে এসব পেঁয়াজ জেলায় জেলায় চলে যাবে,” বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ১২ মাস উৎপাদন হয় এমন জাতের পেঁয়াজ উদ্ভাবন করা হয়েছে। সেটা বাজারজাত করা হবে। ভবিষ্যতে আর পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে না।