করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে কোরবানি বাজার
2020.07.23
ঢাকা
বাংলাদেশে কোরবানির পশু বেচাকেনার চিরায়ত চিত্র বদলে দিয়েছে করোনাভাইরাস। ঈদুল আযহার মাত্র সপ্তাহখানেক বাকি থাকলেও ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় অস্থায়ী পশুর হাট বসেনি এখনও। বেশিরভাগ মানুষই এবার অনলাইনে পশু কিনছেন বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
তবে ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, মহামারির প্রভাবে গত বছরের তুলনায় অন্তত বিশ ভাগ কম পশু বিক্রি হবে এবারের ঈদে।
“মহামারিকালের এই ঈদে কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য থাকা বেশিরভাগ মানুষই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে গরু-ছাগল কিনছেন,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন কেন্দ্রীয়ভাবে কোরবানির পশুর হাট তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ আজিজুর রহমান।
ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকার বাসিন্দা কাজী রুবাইয়াত ইসলাম বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, তাঁদের ফ্ল্যাট মালিক সমিতি এবার কোরবানি দেওয়া যাবে না বলে নোটিশ দিয়েছে। ফলে তাঁর পরিবার একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোরবানি দিচ্ছে।
তিনি বলেন, “সেখানে পুরো একটি গরু কেনার পাশাপাশি ভাগে কোরবানি দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।”
“আমরা সাড়ে ১৭ হাজার টাকার এক ভাগ কিনেছি। তারা আমাদের পক্ষ থেকে কোরবানি দিয়ে মাংসের একাংশ দান করবে, বাকিটা আমাদের পৌঁছে দেবে,” বলেন রুবাইয়াত।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) এর তথ্যানুযায়ী, তাদের সদস্যভুক্ত অর্ধশতাধিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবার কোরবানির পশু বিক্রি করছে।
“এর বাইরে বহু প্রতিষ্ঠান বা ছোট ছোট গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পশু বেচাকেনা করছে,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল।
এছাড়া দেশের ১১ হাজার ডিজিটাল সেন্টারকে সরকারি প্লাটফর্মগুলোর সাথে প্রান্তিক চাষীদের সংযুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
“আমাদের ইউনিয়নে ১০-১২টি খামার আছে। তাঁদের বিক্রয়যোগ্য পশুর তথ্য আমরা অনলাইনে আপলোড করছি,” বেনারকে বলেন মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার মালখানগর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা হাসান দেওয়ান।
প্রসঙ্গত, জুলাইর ৭ তারিখ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ফুড ফর নেশন’-এ কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের ‘ডিজিটাল হাট’ চালুর কথা জানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ।
জুলাইর ১০ তারিখ পশুর হাটের পরিবর্তে অনলাইনে পশু কেনাবেচার সুপারিশ করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
গত ১১ জুলাই যৌথভাবে ডিজিটাল হাট চালু করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি), সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ই-ক্যাব ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ)।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই এই হাট থেকে গরু কেনেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
“ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো প্রান্তিক চাষী বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে গরু নিয়ে আসছে। তাঁদেরকে ক্রেতাদের সাথে সংযুক্ত করছে,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল।
এ বছর ঢাকায় গরু নিয়ে আসতে ব্যবসাীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
‘কোরবানি কম হবে এই বছর’
গত বছর সারা দেশে এক কোটি ছয় লাখ এবং ২০১৮ সালে এক কোটি ১৪ লাখ পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছিল বলে বেনারকে জানান বিডিএফএ সভাপতি ও সাদেক অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন।
তবে করোনা মহামারির কারণে এই বছর “মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অবস্থা খুবই করুণ। উচ্চবিত্তদের অবস্থাও খুব ভালো নেই,” মন্তব্য করে ইমরান বলেন, “এবার কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ কম কোরবানি হবে বলে মনে হচ্ছে।”
“কারণ যারা আট-দশটা বড় গরু কোরবানি দিতেন, তারা এবার কোনোমতে দুই-একটি কেনার কথা বলছেন,” বলেন তিনি।
“গত বছর এমন সময়ে সপ্তাহে কমপক্ষে ৭০০-৮০০ গরু বিক্রি হয়েছিল। এবার মাত্র ২৫০-৩০০ গরু বিক্রি হচ্ছে,” বেনারকে জানান ঢাকার বসিলার মেঘডুবি অ্যাগ্রো ডেইরি ফার্মের সহ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক মাহমুদ জুপিটার।
ইমরান জানান, বিডিএফএ-র ৮৪ হাজার খামারির বাইরেও আরো সাড়ে চার লাখ গরু মোটাতাজাকরণ খামার রয়েছে। তবে কোরবানির বাজারের চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক।
“করোনার কারণে এবার তাঁদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়,” বলেন ইমরান।
এ বছর সারা দেশে কোরবানিযোগ্য মোট পশুর সংখ্যা প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ। এর মধ্যে ৪৫ লাখের বেশি গরু-মহিষ এবং ছাগল-ভেড়াসহ অন্যান্য জাতের পশু প্রায় ৭৪ লাখ রয়েছে বলে বেনারকে জানান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ আজিজুর রহমান।
তবে কোরবানির পশু শুমারি করতে গিয়ে এ বছর অধিদপ্তরের অনেক কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন জানিয়ে আজিজুর রহমান বলেন, “এর মধ্যে চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তা মারা গিয়েছেন।”
কোরবানির সুযোগ কম, বুকিং বাতিল করছেন অনেকে
২০১১ সালে দেশে প্রথম অনলাইনে গরু বিক্রি শুরু করেছিল সাদেক অ্যাগ্রো ফার্ম। এবার ১১ জুলাই থেকে অনলাইনে বুকিং নেওয়া শুরু করে ২০ জুলাইয়ের মধ্যেই এক হাজারের বেশি গরুর অর্ডার পায় তারা।
কিন্তু নিজেদের আবাসিক এলাকায় পশু জবাইয়ের অনুমাতি না পাওয়ায় অনেকেই বুকিং বাতিল করে টাকা ফেরত চাইছেন বলে বেনারকে জানান ফার্মের মালিক ইমরান।
তিনি বলেন, “গত তিন দিনে ২০-১৫ জনকে টাকা ফেরত দিতে হয়েছে। কমপক্ষে আরো ৪০-৫০ জন ফোন দিয়ে বলছেনে, তাঁদের টাকাও ফেরত দিতে হতে পারে।”
“অধিকাংশ আবাসিক এলাকা ও এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সগুলো বলছে, তারা ভিতরে কোরবানির পশু ঢুকতেই দেবে না,” জানিয়ে ইমরান বলেন, “জবাইয়ের সুযোগ না পাওয়ার কারণে এবার অনেকে গরু-ছাগল কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।”
“এ কারণে এবার সাধারণ হাটগুলোতেও ক্রেতা কম হবে,” যোগ করেন তিনি।
তবে ডিজিটাল হাটের আওতায় গরু বিক্রি ছাড়াও তাঁদের প্রায় দুই হাজার গরু কোরবানি দিয়ে মাংস প্রক্রিয়াজাত করে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বলেও জানান ইমরান।
তিনি বলেন, “ঢাকায় ঈদের দিন চারশ, দ্বিতীয় দিন এক হাজার ও তৃতীয় দিন ছয়শ গরু কোরবানি করার সক্ষমতা রয়েছে আমাদের।”
ঢাকায় চারদিনের জন্য বসবে ১৬টি অস্থায়ী হাট
ঢাকার দুই সিটি মিলিয়ে এবার ঈদের আগে চারদিনের জন্য ১৬টি অস্থায়ী পশুর হাট বসার অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ঢাকার স্থায়ী দুই পশুর হাট গাবতলী এবং সারুলিয়ায়ও কোরবানির পশু বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ঢাকা উত্তর সিটির মুখপাত্র এএসএম মামুন বেনারকে বলেন, “ঈদের মাত্র চারদিন আগে হাট বসবে। ঈদের দিন পর্যন্ত বেচাকেনা করা যাবে।”
একই তথ্য জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মুখপাত্র আবু নাছের বেনারকে বলেন, “অনুমোদন ছাড়া কেউ কোথাও হাট বসাতে পারবে না।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে এ বছর কোরবানি ঈদ অনুষ্ঠিত হবে পহেলা আগস্ট।
কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি হাটে স্বাস্থ্যবিধি ও অন্যান্য শর্ত মানা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা থাকবে, হাটগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালতও থাকবে।
এদিকে “মাস্ক ব্যতীত কেউ পশুর হাটে প্রবেশ করতে পারবে না,” বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল ড. বেনজীর আহমেদ।