নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক
2017.02.07
নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ১০ জনের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাতে তুলে দেয় সার্চ কমিটি। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ১০ জনের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাতে তুলে দেয় সার্চ কমিটি। ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৭।
স্টার মেইল

শপথ নেওয়ার আগেই নবগঠিত নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছে রাজপথে সরকারের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তবে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এই কমিশনকে স্বাগত জানিয়েছে। স্বাগত জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।

ফলে এ নিয়ে নিয়ে উত্তাপ কত দূর ছড়াবে এবং ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা–কল্পনা।

সার্চ কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে গত সোমবার সাবেক সচিব কে. এম. নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) করে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ।

কমিশনের অন্য চার সদস্য হলেন; সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরা শপথ নেবেন।

এর মধ্যে আওয়ামী লীগ কবিতা খানম ও বিএনপি মাহবুব তালুকদারের নাম প্রস্তাব করেছিল বলে জানিয়েছেন ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় সাচিবিক দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শফিউল আলম।

তবে নতুন সিইসি নুরুল হুদার নাম কোনো দল থেকে আসেনি। নির্বাচন কমিশনে প্রথম নারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন কবিতা খানম ।

নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিবন্ধনকৃত সব দলের সঙ্গেই কথা বলেছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তিনি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। সার্চ কমিটিও দেশের বিশিষ্ট লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ১০ জনের একটা তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেছিল। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির দেওয়া তালিকা থেকেই পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন।

নতুন সিইসি’র প্রত্যয়

রাজনৈতিক দলগুলো যেন আস্থার সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে তার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করবেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা।

এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, “এটা চ্যালেঞ্জিং। তবে সম্ভব। এটা সাংবিধানিক দায়িত্ব। ব্যক্তি বা দল মুখ্য নয়, দায়িত্বটাই মুখ্য। নিরপেক্ষতার সঙ্গে পালন করা আমার অঙ্গীকার।”

নবনিযুক্ত সিইসি নুরুল হুদাসহ চার কমিশনার। ফাইল ফটো।
নবনিযুক্ত সিইসি নুরুল হুদাসহ চার কমিশনার। ফাইল ফটো।
ফোকাস বাংলা।
নুরুল হুদা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বিসিএস ১৯৭৩ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যুগ্ম সচিব থাকা অবস্থায় তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তৎকালীন সরকারের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি আদালতে যান এবং জয়ী হন।

চাকরি ফিরে পেলেও ২০০৬ সালে বিএনপি ফের ওএসডি করে কে এম নুরুল হুদাকে। পরে অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই অবসরে যেতে হয় সাবেক এই সচিবকে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০০৯ সালে তাকে ভূতাপেক্ষ সচিব করা হয়।

নির্বাচন নিয়ে রক্তাক্ত রাজনীতি

বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে একতরফাভাবে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। সংসদে বিরোধী দলের আসন নেয় দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে বিবেচিত জাতীয় পাটি। নির্বাচন বানচাল করার জন্য ২০১৩ সালের শেষ চার মাস সহিংস আন্দোলন শুরু করেও ব্যর্থ হয় বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর জোট।

নির্বাচনের পর সরকার উৎখাত করার জন্য ২০১৫ সালের প্রথম ৯৩ দিন আবারও সহিংস আন্দোলন করে বিএনপি। চলন্ত যাত্রীবাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা শুরু হয়। দুই ধাপের সহিংস আন্দোলনে প্রথমে ৩১৯ জন এবং পরের ধাপে ১৫২ জন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। নির্বাচনকে ঘিরে এ রকম দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না মানুষ।

প্রধান দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

নতুন নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করলেও এর অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না, এমন চরম বার্তা দেয়নি বিএনপি। কমিশন গঠনের পর দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে দুই দফা দীর্ঘ বৈঠক করে দলটির নীতিনির্ধারক স্থায়ী কমিটি এবং ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।

বৈঠক শেষে মঙ্গলবার রাতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএনপি মনে করে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের প্রতিফলন ঘটেছে । একজন বিতর্কিত সা​বেক সরকারি কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত কোনও প্রতিষ্ঠান নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কাজেই কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্ব সুষ্ঠু, অবাধ, নির​পেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হবে না।

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘সম্পূর্ণ আস্থার’ কথা জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এই কমিশনের অধীনে বিএনপি ভোটে আসবে বলেও তিনি শতভাগ আশাবাদী।

“এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে আসবে, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই,” সাংবাদিকদের জানান ওবায়দুল কাদের।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বেনারকে বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক। যোগ্য, দক্ষ ও সৎ ব্যক্তিরাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পেয়েছেন। তারা নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন।”

তিনি বলেন, “গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সকল রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি নূতন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। বিএনপি-জামায়াত আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশনগুলোর কোনোটিই আলোচনা-মতামতের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। ফলে তা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি হয়।”

নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বেনারকে বলেছেন, “নির্বাচন কেমন হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের ওপর এবং চূড়ান্তভাবে নির্ভর করবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কটি মহলের ওপর।”

নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এ জন্য কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

নতুন নির্বাচন কমিশন যোগ্যতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে বলে মন্তব্য করেছেন বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, “আশা করছি, নতুন নির্বাচন কমিশনও যোগ্যতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।