দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনরা

অয়ন আমান
2024.04.22
ঢাকা
দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা, উপজেলা  নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনরা আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে মনোনয়ন জমা দিচ্ছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ মনজু। ১৫ এপ্রিল ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

দলের শীর্ষ নেতা তথা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশ উপেক্ষা করে সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

দলের সভাপতির কঠোর মনোভাব সাংবাদিকদের মাধ্যমে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়ে দিলেও সোমবার রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত দলীয় সূত্র পাওয়া তথ্য অনুযায়ী,  ১৫ উপজেলায় এমপি-মন্ত্রীদের ১৬ জন নিকটাত্মীয় প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেননি।  সোমবার ছিল প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন।

তবে এই দিন ১৮ উপজেলা থেকে ৩১ প্রার্থী দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন।

আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে ১৫০ টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এগুলোর মধ্যে ৩৩ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন বলে পরিচিত ৪৭ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দেওয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে একবার জনপ্রতিনিধি হতে পারলে দল থেকে ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থাকে বলেই অনেকে দলীয় সভাপতির নির্দেশ মানছেন না।

ইতিমধ্যে কেউ কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন চেয়ারম্যান পদে।  আবার কারো কারো ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল নেতারা।

ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়া হতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার।

তিনি বেনারকে বলেন, “নির্বাচন করার অধিকার সবারই আছে।  কিন্তু মন্ত্রী-এমপির প্রভাব কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি নিজের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা হবে-এমন বাস্তবতা থেকে দল হয়তো এমন সিদ্ধান্ত এসেছে,। এর লক্ষ্য ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকানো, তৃণমূল নেতাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দেওয়া।

কেউ কেউ দলের নির্দেশনা তেমন একটা মানছেন না জানিয়ে শান্তনু মজুমদার বলেন, “তারা হয়তো ভাবছেন, যদি আমি নির্বাচিত হতে পারি তাহলে শাস্তি হলেও তা এক সময় না এক সময় উঠে যাবে।  এমন দৃষ্টান্ত আগেও আছে।  তবে এবার দলের প্রধান প্রকাশ্যে বলার পর যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের কী ধরণের ব্যবস্থার আওতায় আনা হয় সেটা দেখার বিষয়।”

মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনের তথ্য অনুযায়ী, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী অমি।

ওই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আরেকজন প্রার্থী ছিলেন সংসদ সদস্যের স্ত্রী আয়েশা ফেরদাউস। তিনি প্রার্থীতা প্রত্যাহার করায় ছেলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

একই জেলার সুবর্ণচর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি।  জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনাম সেলিম প্রার্থী থাকায় ওই উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

গত ২০ এপ্রিল এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশের কথা সাংবাদিকদের জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের যারা নির্বাচন করছেন, তাদেরকে সরে দাঁড়াতে এবং যারা ভবিষ্যতে করতে চান তাদেরকেও এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে।

এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের যারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে তাদের তালিকা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

ওবায়দুল কাদের বলেন, “দলের তৃণমূল কর্মীরা খুশি হয়েছে।  আমি এমপি, আমি মন্ত্রী, আমার ভাই, ছেলে, শ্যালক তারাও যদি হয় তাহলে তৃণমূলের কর্মীরা কী করবে? তাদের কী জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার নেই? সেই সুযোগটা করে দেয়ার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।”

সোমবার পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৫০ উপজেলার চেয়ারম্যান পদে ৩ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে ৪৫৬ উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৯৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

এই পরিস্থিতি মোটেও সুখকর নয় উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের ওপর থেকে মানুষের আস্থা চলে গেছে।

 “প্রার্থী-ভোটার কারও আর আস্থা নেই। নির্বাচন যে নির্বাসনে চলে গেছে এটা তারই প্রতিফলন।  কিছু সুবিধাভোগী ছাড়া কেউ এখন আর প্রার্থীও হতে চায় না।  যেকারণে স্থানীয় নির্বাচনও জমজমাট হচ্ছে না।”  

“এখন নির্বাচনে শুধু সরকারি দলের লোকেরাই প্রার্থী হতে চান। কারণ এই প্রার্থী হওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার স্বপ্ন থাকে,” যোগ করেন তিনি।

প্রার্থীতা প্রত্যাহারের সুযোগ আছে

যারা প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেননি, তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে বলে জানান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।

তিনি বেনারকে বলেন, “যারা প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেননি, তাদের সময় শেষ হয়ে গেছে বলে আমি মনে করি না।  তারা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ালেও কিন্তু আওয়ামী লীগের নির্দেশ মানা হবে।”

দলের সিদ্ধান্ত ভঙ্গ, বহিস্কার বিএনপির দুই নেতা

বর্তমান সরকারের অধীনে উপজেলা পরিষদসহ কোনও নির্বাচনে অংশ নেওয়া ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।  কিন্তু তারপরও কিছু এলাকায় বিএনপির স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।

ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না বললেও দলটির অনেক স্থানীয় নেতা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।  

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে বলেন, ৪০ জনের মতো নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে। তবে দলীয় নির্দেশনার পর কতজন নির্বাচন থেকে সরে দাড়িয়েছেন এবং কতজন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, সেই তথ্য এখনো আমাদের কাছে আসেনি।

এদিকে রোববার বিএনপির দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পটুয়াখালী জেলাধীন সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনির রহমান এবং কক্সবাজার জেলাধীন ঈদগাহ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর তাজ জনিকে বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।

এবার মোট চার ধাপে ৪৮০টি উপজেলা পরিষদে ভোট হওয়ার কথা। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে ১৫০টি উপজেলা পরিষদে ভোট হবে। দ্বিতীয় ধাপে ১৬৬টি উপজেলা পরিষদে ভোট হবে আগামী ২১ মে।  তৃতীয় ধাপে ১১২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে আগামী ২৯ মে। চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের তফসিল এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।