রাঙ্গামাটিতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ নিহত ৭

শরীফ খিয়াম
2019.03.18
ঢাকা
190318_Electoral_violence_620.jpg রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় ‘অজ্ঞাত’ দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়েছেন দুই নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ মোট সাতজন। হামলার পর নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বহনকারী একটি গাড়ি। ১৮ মার্চ ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত উপজেলা বাঘাইছড়িতে ‘অজ্ঞাত’ দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়েছেন দুই নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ মোট সাতজন। বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়কের নয় মাইল এলাকায় সোমবার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে।

পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাটের তিনটি কেন্দ্রে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট বাকশো ও নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে উপজেলা সদরের কন্ট্রোল রুমে ফেরার পথে হামলার শিকার হন তাঁরা।

রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলমগীর কবির এ তথ্য নিশ্চিত করে বেনারকে জানান, ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন চারজন আনসার ও ভিডিপি সদস্য। এদের মধ্যে দুজন নারী।

পরে বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর মারা গেছেন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মো. আমির হোসেন। তিনি স্থানীয় কিশলয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

নিহত চার আনসার ও ভিডিপি সদস্যরা হচ্ছেন মো. আল আমিন, মিহির কান্তি দত্ত, বিলকিস ও জাহানারা বেগম।

অন্যদিকে বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমএম মঞ্জুরুল আলম সাংবাদিকদের জানান, ঘটনাস্থলের পাশের ঝোঁপ থেকেও এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যাকে মন্টু চাকমা হিসেবে শনাক্ত করেছে স্থানীয়রা। তাঁকে হামলাকারী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।

“নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বহনকারী গাড়িতে সন্ত্রাসীরা ‘ব্রাশফায়ার’ করার সময় আনসার সদস্যদের ছোঁড়া পাল্টা গুলিতে মন্টু নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে,” বলেন ওসি।

তবে মন্টু হামলাকারী কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি উল্লেখ করে এসপি বেনারকে জানান, রাত আটটা পর্যন্ত কেউ এই হামলার দায় স্বীকার করেনি এবং পুলিশও দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করতে পারেনি।

সর্বশেষ চট্টগ্রামে নেওয়ার পথে মারা গেছেন পোলিং অফিসার আবু তৈয়ব।

খবরটি জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাদিম সারওয়ার বেনারকে বলেন, “গুলিবিদ্ধ আরেক প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আবদুল হান্নানসহ আহত অন্যদের হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়েছে।”

তাঁদের চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নুয়েন খীসা বেনারকে বলেন, “১২-১৪ জনকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়েছে, যারা সকলেই গুলিবিদ্ধ। এদের অধিকাংশের উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।”

প্রতিদ্বন্দ্বী জেএসএস দুই গ্রুপ

দ্বিতীয় দফার উপজেলা নির্বাচনের অংশ হিসেবে সোমবার দেশের ১৬টি জেলার যে ১১৬টি উপজেলা পরিষদে ভোট নেওয়া হয়, তারই একটি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি।

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী না দেওয়ায় এই উপজেলায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল দুই আঞ্চলিক দলের মধ্যে। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বর্তমান চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমার বিরুদ্ধে লড়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা।

এর মধ্যে বড়ঋষি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা, আর সুদর্শন সংগঠনটির সংস্কারপন্থী বিদ্রোহী গ্রুপ ‘জেএসএস-এমএন লারমা’ অংশের কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক।

ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন বর্জন করে বড়ঋষি চাকমা অভিযোগ করেন, উপজেলার ১৮টি ভোট কেন্দ্রে এমএন লারমা গ্রুপের সন্ত্রাসীরা ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে দিচ্ছে না। তাঁর পাশাপাশি রাঙ্গামাটির আরও দুই উপজেলার জেএসএস সমর্থিত স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ মোট আটজন ভোট বর্জন করেন।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ও রির্টানিং কর্মকর্তা একেএম মামুনুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, “কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, তাই ভোট কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।”

এদিকে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর হামলার জন্য সন্তু লারমার জেএসএসকে দায়ী করে সুদর্শন সাংবাদিকদের বলেন, “বড়ঋষির চাকমা নিশ্চিত পরাজয় জেনে সকালে নির্বাচন বর্জন নাটক করার পর সন্ধ্যায় সরকারি কাজে নিয়োজিতদের উপর এই নৃশংস হামলা চালিয়েছে।”

তবে জেএসএস’র বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা দাবি করেন, এই ঘটনার সাথে তাঁদের দূরতম সম্পর্কও নেই। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “ওই এলাকার পুরোটা ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নিয়ন্ত্রিত।”

প্রসঙ্গত, গত শনিবার দিবাগত রাতে বাঘাইছড়ির ওই নয় কিলোমিটার এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রসিত বিকাশ খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ’র একটি আস্তানা ধ্বংস করে যৌথবাহিনী। সেখান থেকে পিস্তল-গুলিসহ নগদ টাকা এবং চাঁদা আদায়ের রশিদ উদ্ধার করা হলেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

এর আগে ওই দিন সকালে উপজেলার খেদারমারা ইউনিয়নের বড় দূরছড়ি এলাকায় জেএসএস এর দুই গ্রুপের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়।

নিন্দা জানিয়ে ইসির বিবৃতি

হামলার নিন্দা জানিয়ে নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব (জনসংযোগ) এস এম আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছে।”

“ইসি যেকোনো পরিস্থিতিতে নিহতদের পরিবারের এবং আহতদের পাশে আছে ও থাকবে,” বলে উল্লেখ করা হয় রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে।

এর আগে ভোটগ্রহণ শেষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “১১৬ উপজেলার ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সাত হাজার ৩৯টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র আটটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। বাকি জায়গায় কোনো অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়নি।”

বিএনপিসহ সরকার বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখেও এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে। মোট পাঁচ ধাপে ৪৮০টি উপজেলায় ভোট হবে।

কোনো পদেই প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ৩০টি উপজেলায় ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রায় দেড়শ জন নির্বাচিত হচ্ছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।

আগামী ২৪ মার্চ তৃতীয় ধাপে, ৩১ মার্চ চতুর্থ ধাপে এবং ঈদের পর পঞ্চম ও শেষ ধাপের ভোট হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।